Blogger দ্বারা পরিচালিত.
এই ব্লগের লেখাগুলো বাংলা নিউজ ২৪ থেকে নেয়া। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলো এক পাতায় লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস মাত্র। কোন সত্তাধিকার এখানে ভঙ্গ করা হয়নি। এটির অনুবাদক আদনান সৈয়দ ও প্রকাশক বাংলা নিউজ ২৪।

পর্ব-২

আমার ভায়োলিন শিক্ষক যখন চাকরি নিয়ে শহরে চলে গেলেন তখন আমি লিজ স্কুল অব মিউজিকের নিচের শ্রেণিতে ভর্তি হই। কিন্তু জায়গাটি আমি ভালোবাসতে পরিনি এ কারণেই যে, সেখানকার ছাত্রদের চাইতে আমার বিদ্যের দৌড় ছিলো অনেক বেশি। উৎসবের ছুটির পর আমি আবারও ব্যক্তিগতভাবে ভায়োলিন শেখার সুযোগ পেলাম। একজন বয়স্ক সার্জেন্ট মেজর যিনি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান আর্মি মিউজিক করপোরেশরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তিনি প্রস্তাব দিলেন আমাকে ভায়োলিন শেখাবেন তবে একটি শর্তে। শর্তটি হলো, তিনি আমাকে গোড়া থেকে তার মতো করে অনেকটা সামরিক কায়দায় ভায়োলিন শেখাবেন। এটি ছিলো সত্যিকার অর্থে পুরনো কোপেটস্ককির আর্মিদের ব্যারাক স্কয়ার ড্রিল। মাঝে মাঝে যখন আমি তার সার্জেন্ট মেজাজসুলভ আচরণে বিরক্ত হয়ে পড়তাম তখন তিনি আমাকে আমার বিদ্যের প্রশংসা করে চাঙ্গা রাখতে চাইতেন। তিনি চাইতেন, আমি যেনো সেনাবাহিনীর সঙ্গীতজ্ঞ হয়ে উঠি। কিন্তু আমি কোপেটস্ককির শিক্ষা ত্যাগ করলাম এবং সঙ্গীতের মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হলাম, যেখানে আমার শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক হেইনরিখ ডিসেওয়ার। তিনি ছিলেন সেইসময়ে একজন অসাধারণ সঙ্গীতজ্ঞ ও পণ্ডিত। পাশাপাশি আমি ট্রামপেট, ট্রমবোন ও সঙ্গীতের সূত্র নিয়ে পড়াশুনা শুরু করে দেই এবং পাশাপাশি ছাত্রদের সঙ্গে অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে হাত পাকাতে থাকি। আমি ইতোমধ্যেই সঙ্গীতকে জীবনের একটা অংশ মনে করে এর জন্য ভিন্নরকম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। বাবার কর্মক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করতে না হলে আমি খুব কমই কাউন্সিল স্কুল ছেড়েছি। সেখানে যখন শ্রমিকের সংখ্যা কম থাকতো তখন আমি বাবার সাহায্যে এগিয়ে আসতাম এবং সেভাবেই আমি তার কাজের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করি। পুরনো আসবাবপত্র ঠিকঠাক করে নতুন করে মেরামত করা সত্যি এক কঠিন ও বিরক্তিকর কাজ। সেখানে দিনরাত খেটে পুরনো জিনিসপত্রে নতুনের ছোঁয়া আনতে হতো। কতো পুরনো ও কুৎসিত মেটরেসই না আনা হতো আমাদের এই দোকানে! পুরনো মেটরেসের যে জায়গাটা সারানো হবে সেখানে দাগ দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা হতো। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, সারানো জিনিসপত্রগুলো খুব বেশিদিন টেকসই হতো না। তবে খুব শিগগিরই আমি আমার কাজের আগ্রহ খুঁজে পেলাম এভাবেই যখন ভাবলাম, জিনিসপত্রগুলো সারাতে শিল্পের ছোঁয়া থাকা খুব জরুরি যা বাড়ির আভ্যন্তরীণ শোভা বর্ধনেও কাজে আসবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি সেই সময়টা সঙ্গীত নিয়েই মগ্ন হতাম। আমি যখন আমার কাজে কৃতকার্য হলাম তখন আমার বাবা আমাকে অন্য ওয়ার্কশপেও কাজ করতে প্রেরণা দেওয়া শুরু করলেন। আমি বাবার বিষয়টা ভালো করেই বুঝি। কিন্তু আমার জন্য যে বিষয়টা বেশি জরুরি তা হলো, আমার সঙ্গীতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আসবাবপত্রের নকশা করা আমার কাজ নয়। এ কারণেই আমি আমার বাবার দোকানেই নিজেকে যুক্ত রাখলাম যেখানে কাজকর্মে আমার এক অগাধ স্বাধীনতাও থাকবে। অর্কেস্ট্রায় সেসময়টা অনেক ভালোর দিকেই ছিলো কিন্তু ভালো ভায়োলিনবাদক তেমন কেউ ছিলো না। আমি অধ্যাপক ডিসেওয়ারের প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞ, তিনি আমাকে একজন ভালো ভায়োলিনবাদক হিসেবে তৈরি করেছিলেন। তখন লিজে সঙ্গীতজীবন ছিলো খুব উচ্চ পর্যায়ে। অগাস্ট গোলেরিচ ছিলেন মিউজিক সোসাইটির পরিচালক। বলা যায়, তিনি ছিলেন লিজ শহরের সঙ্গীতের গুরু। প্রতিবছর মিউজিক সোসাইটি তিনটি সিমফোনি কনসার্ট ও একটি বিশেষ কনসার্টের আয়োজন করতো। আমার মা অনেকটা ভিন্ন ধরনের মানুষ হলেও তিনি সঙ্গীত ভালোবাসতেন এবং এই কনসার্টগুলোতে আসতে ভুলতেন না। আমি যখন খুব ছোট তখনই মা আমাকে এই কনসার্টে নিয়ে এসেছিলেন। মা আমাকে সব বিষয় নিয়ে ভালো করে বুঝিয়ে দিতেন। তখন থেকেই আমি অনেক সঙ্গীতযন্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছিলাম। যে কারণে বড় হয়ে আমি অর্কেস্ট্রায় ভায়োলিন অথবা ট্রামপেটবাদক হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করি। তবে পুরনো মেটরেসকে নতুনভাবে গড়িয়ে তোলাই ছিলো আমাদের একমাত্র কাজ। সেই বছরগুলোতে বাবা অনেক সময় পেশাগত কারণে অসুস্থতায় ভুগতেন। একবার হৃদযন্ত্রের সমস্যার কারণে তাকে ছয় মাস শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়েছিলো। সেই সময়টায় আমাকে গোটা ওয়ার্কশপ একাই চালাতে হতো। আমার প্রথম যৌবনে দু’টো বিষয়ে সমানতালে আমি অভিজ্ঞ হচ্ছিলাম। প্রথম হলো, কাজ যা আমাকে চলার পথের শক্তি জুগিয়েছে; দ্বিতীয়টি হলো, সঙ্গীত। সঙ্গীত ছিলো আমার ভালোবাসা। আমি কখনও ভাবিনি যে, এই দু’টো বিষয়ের মাঝে কোনো যোগসূত্র ঘটতে পারে। কিন্তু তাই হয়েছিলো। আমার বাবার কয়েকজন ক্রেতা ছিলেন যারা উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও পাশাপাশি থিয়েটারের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। একদিন তারা এলেন থিয়েটারের স্টেজের আসবাবপত্রগুলো ঠিক করে নিতে। যখন কাজগুলো শেষ হলো তখন বাবা আমাকে আসবাবগুলো থিয়েটারে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দিলেন। স্টেজ ম্যানেজার আমাকে আসবাবগুলো স্টেজের যথাস্থানে সেট করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন। সেসময় স্টেজে রিহার্সাল চলছিলো। কিন্তু বিষয়টা আমি ঠিক বুঝে উঠে পারছিলাম না যে রিহার্সাল কী নিয়ে হচ্ছে। যতোটুকু ধারণা করেছিলাম, ওটা হয়তো কোনো অপেরা হয়ে থাকবে। আমি হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমি স্টেজে একজন অপেরা গায়িকার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমি এই প্রথম নিজের ভেতর থিয়েটার আবিষ্কার করলাম। থিয়েটার! কী এক জগৎ! একজন লোক স্টেজে উঠে আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেনো আমি পৃথিবীর অবাক করা কোনো জন্তু। লোকটি স্টেজে উঠে এমন মধুর গলায় গাইলেন যে, আমার মনে হলো তার পক্ষে কী সাধারণ মানুষের মতো কথা বলা সম্ভব? অর্কেস্ট্রা তার সুললিত গলার সঙ্গে গলা মেলাতে শুরু করলো। এখানে আমি এক খুব সাধারণ মানুষ অথচ সঙ্গীত আমাকে মোহে আচ্ছন্ন করে রাখলো। শুধুমাত্র একটি স্টেজের মাধ্যমে সঙ্গীত যেনো আরও অনেক উচু ও কল্পনার জগতে স্থান পেলো। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে স্টেজের পেছনের আসবাবপত্রটি দণ্ডায়মান, ওখানে কুশনগুলো রাখা ছিলো। কী দুঃখজন অভিজ্ঞতা! বেদানাদায়ক বাস্তবতা! থিয়েটার, যে জগতের সন্ধানে আমি উন্মুখ হয়ে বসেছিলাম। নাটক ও বাস্তবতা আমার মনোজগতে ধন্দ তৈরি করে দিলো। বিশেষ কায়দায় চুল আঁচড়িয়ে একজন নাটকের লোক বিশেষ কায়দায় বেদিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। থিয়েটারে এটা খুব সাধারণ একটি দৃশ্য। আমি থিয়েটারের সবকটি মুহূর্ত অনুভব করছিলাম। আমার কল্পনায় থিয়েটার ছিলো, বাড়ির দেয়াল পরিষ্কার করে সেখানে পত্রিকায় প্রকাশিত নাটকের পোস্টারটি আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া। একসময় আমি এই নিয়ে স্বপ্নও দেখেছিলাম। তবে এই স্বপ্ন আমার বাস্তব জগতে খুব একটা কাজে আসেনি। দেখা যেতো দেয়ালের নতুন ঝকঝকে পোস্টারটি একসময় উঠিয়ে ফেলা হতো। ওয়ার্কশপে ফিরে এলে বাবা বাস্তব দুনিয়ার দায়-দায়িত্ব সম্মন্ধে আমাকে সবসময় সচেতন করে দিতেন। অতএব বাস্তবতা ও স্বপ্ন, এই দুইয়ের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করছিলাম। বাড়িতে আমার মনের ভেতরের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কারও কোনো মাথা ব্যথা ছিলো না। এমনকি আমার মায়ের কাছেও আমার পরিকল্পনা ও জীবনের আকাঙ্ক্ষার বিষয়গুলো গোপন করেছিলাম। কিন্তু তিনি সম্ভবত আমার বিষয়ে কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু আমার কি তার দুঃখকে আরও প্রসারিত করা উচিৎ? আমি নিজেকে কারও উপরই বোঝা মনে করি না। আমি সাঙ্ঘাতিকরকম নিজেকে একাকী ভাবি, নিঃসঙ্গ ভাবি যেমন একজন যুবক জীবনের সুন্দর ও বিপদজ্জক দিকগুলো ভেবে সবসময় উৎকণ্ঠায় থাকে। থিয়েটার আমার জীবনে নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করলো। আমি নাটকের একটি মঞ্চায়নও বাদ দিতাম না। কাজকর্মের পর যখন খুব ক্লান্ত বোধ করতাম তখন নাটক দেখা থেকে আমাকে কোনোকিছুই বিরত করতে পারতো না। স্বাভাবিকভাবেই কাজ করে যে অল্প মজুরি বাবা আমাকে দিতেন তা দিয়ে মিলনায়তনের এক পাশে দাঁড়িয়ে নাটক দেখা ছিলো আমার নিত্যদিনের অভ্যেস। তাই প্রতিদিনই নিয়ম করে নাটক দেখা শুরু করি। তবে দাঁড়িয়ে নাটক দেখার মজাই কিন্তু আলাদা। মঞ্চের সব দৃশ্যপট চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে ধরা দেয়। দাঁড়ানো অংশটুকুর ঠিক সামনেই ছিলো কাঠের তৈরি সুসজ্জিত একটি বড় থামের মতো জায়গা, যেখান থেকে নাটকের ডায়লগ বলা হতো। অতএব দাঁড়িয়ে নাটক দেখার সুবিধা ছিলো অনেক। আমি কখনও কখনও সেই বড় থামের উপর হেলান দিয়ে নাটক উপভোগ করতাম। তবে এটা ঠিক, আপনি সেখানে আগেভাগে না গেলে এই লোভনীয় জায়গাটি নাও পেতে পারেন। সে কারণেই আমি সবসময় মিলনায়তনে আগেই চলে যেতাম এবং সেখানে ডান অথবা বাম যেকোনো একটি থামকে বেছে নিতাম। অনেক সময় দু’টো থামের ভেতর কোনো একটি কেউ আগে থেকেই দখল করে নিতো। বেশ বোঝাই যায়, কারও কারও জায়গাটার প্রতি আগ্রহ আমার চেয়েও বেশি ছিলো। আধা বিরক্ত, আধা বিস্ময় নিয়ে আমি আমার প্রতিযোগীটির দিকে তাকালাম। দেখতে মোটেও সুশ্রী নয়, শুকনো, আমার বয়সী হবে। চোখের পালক না ফেলে সে নাটক দেখেই চলেছে। তার কাপড়-চোপড় আর গাম্ভীর্য দেখে মনে হলো, সে নিশ্চয়ই আমার চেয়েও কোনো ভদ্র পরিবার থেকে এসেছে। সে মগ্ন হয়ে নাটক দেখছে আর নাটকের বিশেষ অংশের নোট তার নোটবুকে টুকে নিচ্ছে। নাটকের বিরতির সময় আমরা একজন আরেকজনের সঙ্গে মত বিনিময় করলাম এবং নাটকের কিছু অংশের সমালোচনা করলাম। আমরা দু’জনে একই সুরে নাটক নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠলাম এবং নাটকের বিশেষ একটি দৃশ্যের সমালোচনা করলাম। আমাদের আলোচনার বিষয় ও নাটক নিয়ে ভাবনা একই রকম হওয়ায় আমরা দু’জনই বেশ পুলকিত বোধ করলাম। আমরা অতি উৎসাহে নাটকের একটি বিষয় থেকে আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। নাটকের জায়গাটায় সন্দেহাতীতভাবে সে আমার চেয়েও অনেক বেশি পণ্ডিত। আবার অন্যদিকে আমরা যখন সঙ্গীত নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম, তখন এই বিষয়ে আমি তার চেয়েও বেশি বিজ্ঞ অনুভব করলাম। তার সঙ্গে দেখা হওয়ার সঠিক তারিখটি আমি দিতে পারছি না তবে আমি নিশ্চিত তা ১৯০৪ সালের সেইন্টস দিবসেই হবে। এভাবে আমাদের অনেক সময় চলে যায়। সে তার ব্যক্তিজীবনের কোনো কথাই আমাকে বলতো না, এমনকি আমিও না। তবে আমরা এ বিষয়টি বুঝে গিয়েছিলাম, নাটক দেখার যে চোখ লাগে তা আমাদের দু’জনেরই ঠিক একই রকমভাবেই ছিলো। একদিন নাটক দেখার পর আমরা একসঙ্গে তার বাড়িতে গেলাম। ৩১, হামবোল্ডস্ট্রেস। আমাদের বিদায় নেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সে তার নাম বললো, অ্যাডলফ হিটলার।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন