ষষ্ঠ অধ্যায়
অ্যাডলফ সর্বক্ষণ তার মায়ের কাছে এটাই
প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো যে, গতানুগতিক পড়াশুনা জীবনে কোনো কাজে লাগে
না। ‘তারচেয়ে বরং একজন ব্যক্তি নিজের চেষ্টায় অনেক বেশি জ্ঞানী হতে পারে’।
সে বিসমার্কস্ট্রেসে অবস্থিত গণশিক্ষা পাঠাগারের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করলো
এবং সেখান থেকে বিনামূল্যে কীভাবে বই ধার করে পড়া যায় সে কাজে ব্যস্ত হয়ে
উঠলো। সে তখন প্রায়সময়ই স্টুয়েলার অ্যান্ড এল হেসলিং বুক কোম্পানি থেকে ধার
করে বই পড়তে শুরু করলো। আমার মনে পড়ে, সেই সময় থেকে সে দিনরাত বইকে আগলে
ধরে সময় কাটাতো। সেই সময় পঠিত তার প্রিয় বইটির নাম ছিলো ‘জার্মান বীরদের
গল্পকথা’। এ বইটি তার গোটা জীবনের সঙ্গে সারাক্ষণ লেপ্টে ছিলো। বই নিয়ে সে
আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে চাইতো। আমি আমার ব্যস্ত জীবনের কাজকর্ম শেষ
করে যখন তার বাড়ি যেতাম তখন তার অনুপ্রেরণায় আমাকে বিভিন্ন স্বাদের বই পড়তে
হতো শুধুমাত্র তার সঙ্গে বই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চালিয়ে নেওয়ার জন্যে। সে তখন
আমার সদ্য পড়া কোনো বই নিয়ে আমার সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে মেতে উঠতো। হঠাৎ করেই
গতানুগতিক স্কুলের পড়াশুনায় সে যেমন বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলো পাশাপাশি ঠিক
একইভাবে সে ব্যক্তিগত পড়াশোনাতেও বেশি পরিমাণ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলো। একান্ত
প্রচেষ্টায় সে পড়াশুনা করে নিজেকে শানিত করে তুললো এবং স্কুলের অভাব পুরণ
করলো।
১৯২৩ সালে লিজ রিয়েল স্কুলে অ্যাডলফ হিটলার খুব ব্যর্থতার সঙ্গে হাইস্কুল পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলো। সেই সময় তার শিক্ষক ছিলেন প্রফেসর হুয়েমার। তিনি অ্যাডলফ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,
‘এক দিক থেকে ভাবলে হিটলার ছিলো গড গিফটেড একটি মেধাবী বালক (ছাত্র হিসেবে)। ব্যক্তি জীবনের শৃঙ্খলাবোধ নিয়ে সে খুব একটা সচেতন ছিলো না এবং প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে সে সবসময় অবস্থান নিতে ভালোবাসতো। যে কারণে গতানুগতিক পড়াশুনায় নিজেকে মানিয়ে নিতে তার কষ্ট হতো। যদি সে এসব বিষয় কাটিযে উঠতে পারতো তাহলে সে অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ ফল করতে পারতো’।
১৯২৩ সালে লিজ রিয়েল স্কুলে অ্যাডলফ হিটলার খুব ব্যর্থতার সঙ্গে হাইস্কুল পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলো। সেই সময় তার শিক্ষক ছিলেন প্রফেসর হুয়েমার। তিনি অ্যাডলফ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,
‘এক দিক থেকে ভাবলে হিটলার ছিলো গড গিফটেড একটি মেধাবী বালক (ছাত্র হিসেবে)। ব্যক্তি জীবনের শৃঙ্খলাবোধ নিয়ে সে খুব একটা সচেতন ছিলো না এবং প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে সে সবসময় অবস্থান নিতে ভালোবাসতো। যে কারণে গতানুগতিক পড়াশুনায় নিজেকে মানিয়ে নিতে তার কষ্ট হতো। যদি সে এসব বিষয় কাটিযে উঠতে পারতো তাহলে সে অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ ফল করতে পারতো’।
অধ্যাপক হুয়েমার তার বিরূপ মন্তব্যের শেষদিকে এসে আবেগঘনিষ্ট হয়ে আরও যোগ করলেন,
‘জীবনের অভিজ্ঞতা আমাদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে। আমাদের ছাত্ররা কেউই সে শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে না। যে কারণে দেখা যায় অনেক উদীয়মানরাও সাফল্যের চূড়ায় যাওয়ার আগেই অকালে ঝরে যায়। এটা বুঝতে হবে যে, স্কুলের পাস প্রকৃত অর্থে কিছুই না যতোক্ষণ না ছাত্রটি তার শিক্ষাকে জীবনমুখী করতে পেরেছে। এটা স্পষ্ট যে, আমার প্রাক্তন ছাত্র হিটলার শেষের এই ক্যাটাগরিতেই পড়ে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করবো, সে যেনো তার ইস্পিত ঠিকানাটি পেয়ে যায় এবং জীবনের সবরকম যন্ত্রনা থেকে মুক্তি লাভ করে’।
‘জীবনের অভিজ্ঞতা আমাদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে। আমাদের ছাত্ররা কেউই সে শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে না। যে কারণে দেখা যায় অনেক উদীয়মানরাও সাফল্যের চূড়ায় যাওয়ার আগেই অকালে ঝরে যায়। এটা বুঝতে হবে যে, স্কুলের পাস প্রকৃত অর্থে কিছুই না যতোক্ষণ না ছাত্রটি তার শিক্ষাকে জীবনমুখী করতে পেরেছে। এটা স্পষ্ট যে, আমার প্রাক্তন ছাত্র হিটলার শেষের এই ক্যাটাগরিতেই পড়ে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করবো, সে যেনো তার ইস্পিত ঠিকানাটি পেয়ে যায় এবং জীবনের সবরকম যন্ত্রনা থেকে মুক্তি লাভ করে’।
অধ্যাপক মশাইয়ের এই কথাগুলো ১৯২৪ সালে যখন
লিপিবদ্ধ করেছিলেন তখন তা ছিলো সম্পূর্ণরূপে ‘রাজনৈতিক’ উদ্দেশ্য বর্জিত।
এই বাক্যগুলোর মাধ্যমে একজন শিক্ষক এবং তার ছাত্রের মধ্যে অসাধারণ ভালোবাসা
প্রকাশ পেয়েছে। অধ্যাপক হুয়েমার তার লেখায় অ্যাডলফ হিটলার সম্পর্কে যে
ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন তা পরবর্তীতে সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো। হিটলার ক্লাসে
ভালো কোনো ছাত্র ছিলো না। এমনকি অধ্যাপক হুয়েমারের নেওয়া জার্মান ভাষা
শিক্ষা ক্লাসেও সে ভালো ফল করতে পারেনি। পরবর্তীতে আমাকে লেখা তার জার্মান
ভাষায় পত্রাবলি এবং বিভিন্ন উৎসবে পাঠানো পোস্টকার্ডে তার ভুলভাল জার্মান
লেখাতেও তার প্রমাণ পেয়েছিলাম।
হিটলারের আরেকজন শিক্ষক ইতিহাসের নাম থিয়োডর
গিসিংগার যিনি হিটলারের রাজনৈতিক দুরদর্শতির অনেক গুণকীর্তন করেছিলেন।
গিসিংগার অধ্যাপক এংসলারের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। গিংসিংগার স্কুলের বাইরে
বিভিন্ন রকম আউটডোর কাজকর্ম করতে ভালোবাসতেন। তিনি পর্বত আরোহণ থেকে শুরু
করে দূরপাল্লায় ভ্রমণবিলাস সব কাজই করতেন। তিনি ছিলেন সব জাতীয়তাবাদী
শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কঠোর। সেসময় রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণ এবং
স্কুলের নিয়মনীতি অনেক কঠোরভাবে মেনে চলা হতো। আর এই বিষয়টি হিটলারের
মানসিক বিকাশের পথে ছিলো চরম অন্তরায়। অধ্যাপক গিসিংগার তার প্রাক্তন
ছাত্রটি সর্ম্পকে স্মৃতিকথায় লিখলেন,
‘লিজে থাকাকালীন হিটলার ভালো কী খারাপ, কোনো ছাপই আমার কাছে রাখতে পারেনি। সে ক্লাসের নেতৃস্থানীয় কেউ ছিলো না। দেখতে সে ছিলো শীর্ণকায়, মুখটি ছিলো বুদ্ধিদীপ্ত, শান্ত। সে ছিলো কৌতুহলী এবং তার চোখ ছিলো জ্বলজ্বলে’।
‘লিজে থাকাকালীন হিটলার ভালো কী খারাপ, কোনো ছাপই আমার কাছে রাখতে পারেনি। সে ক্লাসের নেতৃস্থানীয় কেউ ছিলো না। দেখতে সে ছিলো শীর্ণকায়, মুখটি ছিলো বুদ্ধিদীপ্ত, শান্ত। সে ছিলো কৌতুহলী এবং তার চোখ ছিলো জ্বলজ্বলে’।
তৃতীয় আরেকজন ইতিহাসের অধ্যাপক ডক্টর লিয়োপোল্ড পোচ হিটলারের গুণকীর্তন করে একটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন। তিনি একমাত্র অধ্যাপক যিনি তার ছাত্র হিটলারের বহুমুখী প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। এ বিষয়টি অ্যাডলফ হিটলারের আত্মজীবনী ‘মেইন ক্যাম্ফ’-এ বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
‘আমার ইতিহাসের শিক্ষক আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছিলেন তা সম্ভবত আমার পরবর্তীতে জীবনে আমার পাথেয় হয়ে থাকবে। যারা তাকে চেনেন তারা জানেন যে, তিনি তার ক্লাস এবং পরীক্ষা নিয়ে কতো বেশি মগ্ন থাকতেন। জীবনে যা অপ্রয়োজনীয় তিনি তা পরিহার করে চলতেন। আমার ইতিহাসের শিক্ষক ডক্টর লিয়োপোল্ড পোচ এই আদর্শ শিক্ষকের আচরণে তার প্রতি মাথা সবসময় শুধুই নত হয়ে আসে তা নয় পাশাপাশি তার কথা ভাবলেই যেনো অনুপ্রেরণা খুঁজে পাই’।
লিয়োপোল্ড পোচই একমাত্র শিক্ষক যাকে নিয়ে
হিটলার তার মেইন ক্যাম্ফে আড়াই পাতা বিষদভাবে লিখেছিলো। হতে পারে শিক্ষকের
প্রতি তার এই ভালোবাসার প্রকাশ অনেকটাই অতিরিক্ত ছিলো কিন্তু এই বিষয়টা
মাথায় রাখতে হবে যে, হিটলার শুধুমাত্র তার এই শিক্ষকের ইতিহাস ক্লাস থেকেই
‘সন্তোষজনক’ ফল পেয়েছিলো। সম্ভবত তার স্কুল পরিবর্তনও এমন ফল হওয়ার অন্যতম
কারণ হতে পারে তবে এটাও ঠিক যে, ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক যেভাবে এক
যুবক ছাত্রের মনোজগত তৈরি করে দিয়েছিলেন, তার সেই দক্ষতাকে কোনোভাবেই
অস্বীকার করার উপায় নেই।
পোচ দক্ষিণ অস্ট্রিয়ান ছিলেন। সেখান থেকে
তিনি লিজে পড়ানোর আগে তিনি মারবার্গ এন ডার ড্রাও (পরবর্তী যুগোস্লাভিয়াতে
অবস্থিত) এবং বিভিন্ন স্কুলেও পড়িয়েছিলেন। যে কারণে তিনি তার সঙ্গে করে
বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। আমার মনে হয় জার্মান ভাষাভাষী
মানুষের প্রতি অদম্য ভালোবাসাই হয়তো যুবক হিটলারের প্রতি তার দুর্বলার
কারণ হয়ে দাড়িয়েছিলো। হিটলার সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই তার স্কুল জীবনের
ইতিহাসের শিক্ষককে তার স্মৃতিকথায় স্মরণ করেছিলো। ১৯৩৮ সালে হিটলার যখন
ক্লেগেনফার্ট পরিদর্শন করে তখন অধ্যাপক পোচের সঙ্গে তার আবার দেখা হয়েছিলো।
তিনি তখন লেভেন্থালের সেন্ট অনড্রিল স্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন। হিটলার এক
ঘণ্টা একান্তে তার প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলো। তাদের আলাপচারিতায়
কোনো সাক্ষী ছিলো না তবে জানা যায়, হিটলার যখন তার শিক্ষকের কাছ থেকে
বিদায় নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে তখন সে তার দেহরক্ষীকে বলেছিলো, ‘তোমার কোনো
ধারণাই নেই যে, আমি কী পরিমাণে এই বৃদ্ধ লোকটার কাছে ঋণী হয়ে আছি’।
একজন শিক্ষকের প্রতি কী পরিমাণ ভালোবাসা
থাকলে অ্যাডলফ হিটলার তার প্রাক্তন শিক্ষক সম্পর্কে এ ধরনের প্রশংসামূলক
কথা বলতে পারে যা ছিলো তার প্রতি সহপাঠীর বিরূপ মন্তব্যের ঠিক বিপরীত*। আমি
নিজে সাক্ষী, অ্যাডলফ তার স্কুল ছেড়েছিলো শুধুমাত্র স্কুলের প্রতি প্রচণ্ড
ঘৃণা থেকেই। স্কুল নিয়ে যখনই আমরা কোনো আলোচনায় মেতে উঠতাম তখনই সে
রেগেমেগে আগুন হয়ে যেতো। স্কুল ছাড়ার পর সে কোনো শিক্ষক বা ছাত্র এমনকি
অধ্যাপক পোচের সঙ্গেও কোনোরকম যোগাযোগ রাখেনি। রাস্তায় কখনও হঠাৎ করে তাদের
মুখোমুখি হয়ে গেলে সে তাদেরকে কৌশলে এড়িয়ে যেতো।
*স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে হিটলারের সম্পর্ক
কখনই ভালো ছিলো না। হিটলার তাদের ঘৃণা করতো একারণেই যে, তার ধারণা ছিলো এরা
সবাই বড় হয়ে অমানুষ হবে। সরকারি বড় কোনো কর্মকর্তা হবে। আর কিছুই নয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন