Blogger দ্বারা পরিচালিত.
এই ব্লগের লেখাগুলো বাংলা নিউজ ২৪ থেকে নেয়া। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলো এক পাতায় লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস মাত্র। কোন সত্তাধিকার এখানে ভঙ্গ করা হয়নি। এটির অনুবাদক আদনান সৈয়দ ও প্রকাশক বাংলা নিউজ ২৪।

পর্ব ২১


ঘোড়ার গাড়ি থেকে স্টেফেনির হাত থেকে ফুলের তোড়া পাওয়ার পর অ্যাডলফ যেভাবে আনন্দ সাগরে ভেসেছিল সত্যি বলতে আমি অ্যাডলফের চোখে সেই আনন্দের জোয়ার আর কখনোই দেখিনি। স্টেফেনিকে বহন করে নিয়ে আসা ঘোড়ার গাড়িটি আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই অ্যাডলফ আবেগের চোটে আমাকে টান দিয়ে ধরে রাস্তার একটা পাশে নিয়ে এলো এবং গভীর ভালোবাসায় ফুলগুলোকে জড়িয়ে ধরলো। আমি তার কণ্ঠস্বর এখনো যেন শুনতে পাই। আনন্দ আর উত্তেজনায় সে আমাকে বলছে, ‘সে আমাকে ভালোবাসে! দেখেছ! সে আমাকে কত ভালোবাসে!’
পরবর্তী মাসে অ্যাডলফ যখন তার স্কুল ছাড়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছিল এবং এই নিয়ে তার মায়ের সাথে মনোমালিন্য হচ্ছিল তখন সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং সেই কঠিন সময়ে তার বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল স্টেফেনির ভালোবাসা। সে অনেক যত্ন নিয়ে স্টেফেনির দেওয়া ফুলের তোড়াটি তার গোপন একটা বাক্সে রেখে দিয়েছিল। সেই সময় অ্যাডলফের কোনো বন্ধুর প্রয়োজন ছিল না কারণ আমিই তার একমাত্র বন্ধু যার কাছ থেকে সে নিয়মিতভাবে স্টেফেনির সব গোপন খবর পেয়ে যেত। আমাকে প্রতিদিন সেই একই জায়গায় যেখানে স্টেফেনিকে দেখতে পাওয়া যায় সেখানে যেতে হতো এবং তার সম্পর্কে বিশদ খবর সংগ্রহ করে তাকে দিতে হতো। বিশেষ করে স্টেফেনির সাথে অথবা তার মায়ের সাথে অন্য কারো কোনো কথা হয়েছিল কিনা অথবা কারো কোনো উপস্থিতি ছিল কিনা সে খবরটি তাকে আমাকে নিয়ম করে জানাতে হতো। যেহেতু অ্যাডলফ অসুস্থ তাই তাকে ছাড়াই আমি যখন আমাদের সেই পরিচিত জায়গাটিতে স্টেফেনির জন্যে অপেক্ষায় থাকবো তা দেখে স্টেফেনি হয়তো মন খারাপ করবে। অ্যাডলফ সেরকমটাই ভেবেছিল। কিন্তু স্টেফেনির ক্ষেত্রে এমন কোনো ঘটনা ঘটলো না এবং তা আমি অ্যাডলফের কাছে গোপন রেখেছিলাম। ভাগ্যক্রমে ঘুনাক্ষরেও অ্যাডলফের মনে কখনোই এমন সন্দেহ বাসা বাঁধেনি যে আমি স্টেফেনির খোঁজ নিতে যেয়ে আবার নিজেই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছি! বন্ধুত্বের চির ধরতে পারে এ জন্যে এই সন্দেহই যথেষ্ট ছিল। আমি অবশ্য আমার প্রিয় বন্ধুটিকে স্টেফেনি সম্পর্কে সব রকম তথ্যই নিয়মিত সরবারহ করছিলাম।
অ্যাডলফের মা দীর্ঘদিন ধরেই তার পুত্রের এই ধরনের পরিবর্তন সম্পর্কে অবগত ছিলেন। আমি বিষয়টি বেশ জোরালোভাবে মনে করতে পারছি এ কারণেই যে বিষয়টি আমাকেও বিব্রত করেছিল। একদিন অ্যাডলফের মা আমাকে সরাসরিই প্রশ্ন করলেন: ‘অ্যাডলফের কী হয়েছে? সে তোমাকে দেখার জন্যে পাগলের মতো হয়ে থাকে?’ আমি তার এ ধরনের প্রশ্নবানে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম এবং দ্রুত অ্যাডলফের কক্ষে প্রবেশ করে সে যাত্রায় নিজেকে রক্ষা করেছিলাম।
অ্যাডলফ সবসময় খুব খুশি হতো যখন আমি তার জন্যে স্টেফেনি সংক্রান্ত কোনো খবর নিয়ে আসতে পারতাম। ‘তার কণ্ঠস্বর অনেক মিষ্টি আর মোলায়েম’। একদিন আমি এই কথাটা অ্যাডলফকে বলতেই সে তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠলো। চোখ কপালে উঠিয়ে সে আমাকে বললো, ‘তুমি তা জানলে কীভাবে দোস্ত!’ আমি তাকে খুব কাছে থেকে অনুসরণ করতাম এবং সে যখন কথা বলতো তখন খুব কাছ থেকে তার কণ্ঠ আমি শুনতে পেরেছিলাম। সঙ্গীত সম্পর্কে আমার অনেক অভিজ্ঞতা থাকায় আমি কারো কণ্ঠ শুনলেই বলে দিতে পারতাম যে সেটি সুরেলা বা মিষ্টি কিনা। এ কথা শুনে অ্যাডলফের আনন্দ যেন ধরে না! কতই না সুখি দেখাতো তাকে! আমার এটা দেখে খুব ভালো লাগতো যে সয্যাশায়ী হয়ে কেউ অন্তত এক মুহূর্তের জন্যে হলেও সুখি হতে পেরেছে।
প্রতি বিকেলেই আমি হামবোল্ডস্ট্রের যে বাড়িটায় অ্যাডলফ থাকে সে বাড়িতে যাওয়ার শর্টকাট যাওয়ার পথটার দিকে পা বাড়াতাম। প্রায় সময়ই আমি দেখতে পেতাম অ্যাডলফ আপন মনে নিজেই একটি বাড়ির নকশা আঁকায় নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। ‘আমি এখন আমার মনস্থির করে ফেলেছি।’ আমার কাছ থেকে ব্যাগ্রভাবে স্টেফেনির খবর শোনার পর সে বললো। ‘আমি ঠিক করেছি আমি এই বাড়িটা স্টেফেনির জন্যে রেনেসাঁর স্টাইলে তৈরি করে দেব।’ তারপর আমাকে এই বিষয়ে একটা মতামত দিতে হতো। বিশেষ করে সে বাড়িটার সঙ্গীত কক্ষটি কেমন হবে এবং কীভাবে হবে এই নিয়ে। সে এই কক্ষটিতে পিয়ানোটি কোন দিকে বসবে বা বসালে ভালো হবে এই নিয়ে আমাকে মত দিতে হতো। তার বক্তব্যগুলো এমনভাবেই পেশ করা হতো যে পরিকল্পনা মতো বাড়ি সে করতে পারবে কি পারবে না এই নিয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকতো না। এমন বাড়ি করতে টাকা কোথায় পাবে? এ ধরনের প্রশ্ন শুনলেই সে রাগে চিৎকার করে বলে উঠতো, ‘ওহ! টাকা দোজখে যাক।’ যেমনটা সে সবসময় টাকার বিষয় উঠলেই এভাবে বলে থাকতো।
বাড়িটা কোথায় তৈরি হবে এই নিয়ে আমাদের দু বন্ধুতে বেশ তর্ক-বিতর্ক হতো। একজন সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে আমার প্রথম পছন্দের জায়গা ছিল ইতালি। কিন্তু অ্যাডলফের মত ছিল এটি অবশ্যই জার্মানিতে হবে এবং কোনো শহরের উপকণ্ঠেই হবে। কারণ তাতে সে এবং স্টেফেনি দুজনেই সপ্তাহান্তে অপেরা এবং নাটক দেখতে যেতে পারবে।
অ্যাডলফ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুস্থ হয়ে উঠেই দ্রুত স্কিমিয়েডটরে পথে  স্টেফেনিকে দেখার জন্যে ঠিক সময়ে চলে গেল। তখনও সে খুব রুগ্ন এবং শারীরিকভাবে খুব দুর্বল। স্টেফেনি এবং তার মাকে দেখা গেল। অ্যাডলফের রোগা পাতলা চেহারা আর গর্তে যাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে স্টেফেনি মুচকি হাসলো। ‘তুমি কী লক্ষ্য করেছ?’ সে আমাকে আনন্দের সাথে প্রশ্ন করলো। সেই সময় থেকে তার শরীর দ্রুত ভালো হতে শুরু করলো।
১৯০৬ সালে অ্যাডলফ ভিয়েনা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সে আমাকে বিশদভাবে একটি নির্দেশনা দিয়েছিল যে কীভাবে আমি স্টেফেনির সাথে কথা বলবো এবং তার কথার উত্তর দেব। তার ধারণা ছিল স্টেফেনি হয়তো খুব শিগগিরই আমাকে একা থাকতে দেখে অ্যাডলফের শারীরিক অবস্থা নিয়ে খোঁজ-খবর জানতে চাইবে এবং এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে। তখন আমাকে যে উত্তর দিতে হবে তা হলো: আমার বন্ধু অসুস্থ নয়। কিন্তু তাকে একাডেমি অব আর্টসে উচ্চতর পড়াশোনার জন্যে ভিয়েনায় যেতে হয়েছে। যখন তার পড়াশোনা শেষ হয়ে যাবে তখন সে এক বছরের জন্যে দেশের বাইরে লম্বা ছুটি কাটাতে চলে যাবে। আমি অবশ্য তাকে দেশের বাইরে না বলে ‘ইতালি’ বলতে বলেছিলাম। ‘ইতালি?’ ঠিক আছে তাই হোক। বলবে ইতালিতে এক বছরের জন্যে ছুটি কাটাতে চলে যাবে। এবং চার বছরের মধ্যেই সে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। তার কাছ থেকে হ্যাঁ বোধক কোনো উত্তর আসার সাথেই সাথেই বিয়ের সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে ফেলতে হবে।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন