অ্যাডলফ যখন ভিয়েনায় তখন নিয়মিতভাবে আমি তাকে লিখিতভাবে স্টেফেনি বিষয়ে
তথ্য পাঠাতাম। যেহেতু পোস্টকার্ড সেই সময় চিঠির খামের চেয়ে সস্তা ছিল সে
কারণে আমি পোস্টকার্ডেই তাকে লিখতাম। পোস্টকার্ডে স্টেফেনির নাম গোপন রাখার
জন্যে অ্যাডলফ তার একটি সংক্ষিপ্ত বা ছদ্মনাম আমাকে দিয়েছিল। নামটি ছিল
বেনকাইসের। হিটলারের এক সময়ের কোনো এক সহপাঠিনীর নাম। আমি পোস্টকার্ডে
স্টেফেনির পরিবর্তে বেনকাইজার উল্লেখ করতাম। মনে পড়ে ৮ মে আমাকে লেখা ছবি
সহযোগে একটি পোস্টকার্ডে সে আমাকে লিখেছিল যে ভিয়েনায় এত নতুন নতুন বিষয়
থাকা সত্ত্বেও সে এখনো কি পরিমাণে বেনকাইসেরকে মনে করে। ‘আমি আমার প্রিয়
লিজ এবং ওরফাত শহরে চলে আসার জন্যে তৈরি হয়ে আছি। তারপরেই নিচে আন্ডারলাইন
করে লেখা’ অবশ্যই সেই শহরে যে শহরে স্টেফেনি বসবাস করে। বেনকাইসের সাথে
আমার আবার দেখা হবে, সে এখন কি জানি করে।’
তার কয়েক সপ্তাহ পরেই অ্যাডলফ ভিয়েনা থেকে চলে এলো এবং তার সাথে দেখা
করতে আমি রেল স্টেশনে চলে গেলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে তার ব্যাগ নিয়ে
স্টেশন থেকে বেড় হতে হতেই অ্যাডলফ আমাকে স্টেফেনি সম্পর্কে যাবতীয় খবর
জানতে চাইলো। আমরা একটু তাড়াতাড়িই হাঁটছিলাম কারণ আর ঘণ্টাখানেক বাদেই
আমাদের বিকেলের ভ্রমণে বের হতে হবে। আর এদিকে অ্যাডলফ হয়তো এ কথা বিশ্বাসই
করতে চাইবে না যে স্টেফেনি তার অনুপস্থিতিতে তার কোনো খবর নেয়নি। কিন্তু
অ্যাডলফ ধারণা করেছিল স্টেফেনি হয়তো তাকে দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে বসে আছে
যেমনটা অ্যাডলফের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। তবে অ্যাডলফ এ কথা ভেবে খুবই আনন্দিত যে
আমি তার ভবিষ্যত পারিকল্পনার কথাটা তখনও স্টেফেনিকে বলিনি। কেননা তার
পরিকল্পনায় ভবিষ্যত জীবন যেমন হওয়ার কথা ছিল তেমনটি হতে পারেনি*। আমরা
দ্রুত পায়ে হেটে হামবোল্ডস্ট্রেসে তাদের বাড়িতে যেয়ে অ্যাডলফের মায়ের সাথে
দ্রুত দেখা করতে গেলাম। কেননা তারপরই আমাদের স্টেফেনির সাক্ষাতের আশায়
স্কেমিয়েডটরেক এর পথে হাঁটা দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত গভীর উত্তেজনায় অ্যাডলফ
আর আমি সেখানে স্টেফেনির অপেক্ষায় বসে রইলাম। নির্দিষ্ট সময়ে স্টেফেনি এবং
তার মাকে দেখা গেল। স্টেফেনি দূরে অ্যাডলফকে দেখতে পেয়ে তার দিকে বিস্ময়ের
চোখে তাকাল। অ্যাডলফের জন্যে এটাই যথেষ্ঠ ছিল। কিন্তু আমার ধৈর্য যেন বাঁধ
মানে না। আমি আমার বন্ধুটিকে বললাম, ‘আমার মনে হয় স্টেফেনি তোমার সাথে কথা
বলতে চাচ্ছে।’ তার উত্তর, ‘ঠিক আছে, আগামীকাল বলবো’।
কিন্তু অ্যাডলফের জীবনে ‘আগামীকাল’ আর কখনো আসে না। বছর যায়, মাস যায়,
সপ্তাহ যায় স্টেফেনির প্রতি তার গোপন প্রণয় ধীরে ধীরে খুব যন্ত্রণার কাঁটা
হয়ে থাকলো। এটা স্বাভাবিক যে অ্যাডলফের প্রতি স্টেফেনির যে প্রথম দৃষ্টি
বিনিময় ঘটেছিল তা দিয়ে তেমন কিছু আশা করা যায় না। অ্যাডলফ সবচেয়ে বেশি যে
স্মৃতিটাকে নিয়ে এখনো আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে তা হলো- ফুল উৎসবে স্টেফেনি এক
গোছা ফুল তার দিকে ছুড়ে মেরেছিল। এই পর্যন্তই। এই স্মৃতিটাই অ্যাডলফ তার
হৃদয়ে পোষণ করে রেখেছিল। এই ঘটনাটা শুধুমাত্র স্টেফেনির ক্ষেত্রে আরো অন্য
কোন নারী জাতির মতোই মেয়েলি কোনো ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও তা অ্যাডলফের জীবনের
ভবিষ্যত পারিকল্পনার জন্যে বড় একটি বিষয় হয়ে উঠেছিল। সে নিজেই এই বিষয়টা
নিয়ে দেখভাল করছিল এবং তার এই ব্যর্থতার দায় খুব সূক্ষভাবে হলেও সে তা
নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
অবশ্যই, স্টেফেনি দেখতে সুন্দরী এবং আরো হাজার নারীর মতোই সেও মনে
প্রাণে সুখি এবং বয়সে তরুণী এক নারী। এই মেয়েকে না পাওয়ার বেদনায় অ্যাডলফ
নীল হতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক। অ্যাডলফ কল্পনায় স্টেফেনি নামের এমন একটি
নারীকেই সে তার জীবনের সাথে লেপ্টে রেখেছিল।
এ কথা সত্য যে যুবক অ্যাডলফ সেই সময়ের যাবতীয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে
নিজেকে দাঁড় করাতে ভালোবাসতো এবং মধ্যবিত্তদের তৈরি করা সমাজকে ঘৃণার চোখে
দেখতো, সেই যুবকের স্টেফেনির প্রতি অন্ধের মতো প্রেমে পড়াটা অনেকটাই চোখের
পড়ার মতো এক ঘটনা। সেই সময়ে মধ্যবিত্ত সমাজের তৈরি করা কিছু নিয়ম নীতিমালা
স্টেফেনির প্রতি গভীর ভালোবাসাতে অনেকটুকুই ব্যাহত করেছিল। ‘আফসোস! তার
সাথে আমার এখনো কোনো পরিচয় হয়ে উঠেনি’- এই কথাটা আমি তার কাছ থেকে প্রায়
সময়ই শুনতে পেতাম। যদিও সেই সময়ে সে খুব স্বাভাবিকভাবে সমাজের সব বাধাকে
অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সমাজের এই কঠিন নীতিমালা তার স্বাভাবিক
প্রাকৃতিক জীবনের অন্যতম একটা বাধা হয়ে রয়ে গেল। তার ভদ্র জামা কাপড়,
শালীন ব্যবহার তা সবই ছিল তার প্রকৃতিগতভাবেই প্রাপ্ত। আমার মা এ জন্যে
তাকে খুব ভালোবাসতো। আমি কখনো শুনিনি যে অ্যাডলফ এমন কোনো গল্প বলছে যা
কিনা বোগাস এবং সন্দেহপূর্ণ।
সুতরাং এই সব ঝুট ঝামেলা থাকা সত্ত্বেও স্টেফেনির প্রতি অ্যাডললের এই
অদ্ভুত ভালোবাসা তার চরিত্রকে অন্যরকম একটা পরিচিতি দিয়ে দিলো। ভালোবাসা
এমন একটা বিষয় যেখানে অনেক অবদমিত শক্তির প্রকাশ ঘটে এবং যা মাঝে মাঝে
ধ্বংসাত্মকও হয়ে ওঠে। এমন কত পুরুষ আছেন যারা তাদের ভালোবাসার ইপ্সিত
লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে যে পথ দিয়ে হাঁটছিলেন তা শেষ পর্যন্ত জটিল প্রণয়ের
আখ্যানে পরিণত হয়েছে।
যুবক হিটলার স্টেফেনির প্রতি ভালোবাসায় আসক্ত হয়ে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে
যা অর্জন করেছিল তা হলো, স্টেফেনিকে ভালোবাসতে যেয়ে ভালোবাসাকে অর্জন করা
এবং পাশাপাশি স্টেফেনিকে হারানোর বেদনা। সে সারাজীবন এই বিশ্বাস করতো যে,
সে যাকে ভালোবেসেছিল সেই নারীটি একান্তই তার হয়েই থাকবে। কিন্তু যেহেতু সে
ব্যাক্তিগত স্বভাব অনুযায়ী স্টেফেনির মুখোমুখি হতে পারতো না সে কারণে সে
স্টেফেনিকে তার কল্পনায় বসিয়ে নানাভাবে দেখতে পেত। তার সেই স্বপ্ন
শুধুমাত্র স্বপ্নেই রয়ে গেল। সে কারণে সে সব সময় তার ব্যক্তিগত ভাবনা এবং
চিন্তাকে স্টেফেনি নামের এই নারীর প্রতি তার যে ভালোবাসা সেই ভালোবাসকে তার
ব্যক্তিজীবনের নানান অনুসর্গ থেকে আলাদা করে রাখলো। সে কল্পনায় ভাবতো
স্টেফেনি তার স্ত্রী, সে সুন্দর একটি বাড়ি তৈরি করছে যেখানে সে স্টেফেনিকে
নিয়ে সুখের জীবন কাটাবে, যে বাড়িটার চারপাশে সুন্দর ফুলের বাগান থাকবে আর
সেই বাগানে স্টেফেনিকে নিয়ে তার ভালোবাসার সময় কাটবে। সত্যি বলতে তার
কল্পনায় বিচরণ করা এমন একটি বাগান সে সত্যি সত্যি ওবারসালবার্গ শহরে
বানিয়েছিল, যদিও সে বাগানটিতে তখন স্টেফেনি ছিল না। এই স্বপ্ন এবং
বাস্তবতার মিশ্রণই হল একজন যুবক হিটলারের প্রতিকৃতি। যে কারণে যখনই
হিটলারকে কোন দুঃসময় পাড়ি দিতে হয়েছে অথবা কোনো স্মৃতি তাকে তাড়িত করেছে সে
স্কেমিয়েডটরেক এর এই স্মৃতিঘেরা পার্কে চলে এসেছে এবং কল্পনায় স্টেফেনিকে
আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছে। হিটলার তার জীবনে বাস্তব স্টেফেনিকে যত না
ভালোবাসতো তার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে তার কল্পনায় আগলে রাখা নানান রঙে আঁকা
স্টেফেনিকে দেখতে। অতএব হিটলারের জীবনে স্টেফিনির উপস্থিতিকে দুটো ভাগে ভাগ
করা যায়। প্রথমটি হল বাস্তবতা এবং দ্বিতীয়টি হল কল্পনা। অতএব শেষ কথা এই
বলা যায় যে স্টেফেনি ছিল হিটলারের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর, সুচারু এবং
পবিত্রতম এক স্বপ্ন।
* হিটলার, ভিয়েনায় একাডেমি অব আর্টস এ ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে
পারেনি এবং চারুকলা নিয়ে তার উচ্চতর পড়াশুনাও আর হয়ে ওঠে না। সে কারণে সে
দ্রুত আবার ভিয়েনা ছেরে তার লিজ শহরে চলে আসে।