Blogger দ্বারা পরিচালিত.
এই ব্লগের লেখাগুলো বাংলা নিউজ ২৪ থেকে নেয়া। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলো এক পাতায় লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস মাত্র। কোন সত্তাধিকার এখানে ভঙ্গ করা হয়নি। এটির অনুবাদক আদনান সৈয়দ ও প্রকাশক বাংলা নিউজ ২৪।

পর্ব ২২

অ্যাডলফ যখন ভিয়েনায় তখন নিয়মিতভাবে আমি তাকে লিখিতভাবে স্টেফেনি বিষয়ে তথ্য পাঠাতাম। যেহেতু পোস্টকার্ড সেই সময় চিঠির খামের চেয়ে সস্তা ছিল সে কারণে আমি পোস্টকার্ডেই তাকে লিখতাম। পোস্টকার্ডে স্টেফেনির নাম গোপন রাখার জন্যে অ্যাডলফ তার একটি সংক্ষিপ্ত বা ছদ্মনাম আমাকে দিয়েছিল। নামটি ছিল বেনকাইসের। হিটলারের এক সময়ের কোনো এক সহপাঠিনীর নাম। আমি পোস্টকার্ডে স্টেফেনির পরিবর্তে বেনকাইজার উল্লেখ করতাম। মনে পড়ে ৮ মে আমাকে লেখা ছবি সহযোগে একটি পোস্টকার্ডে সে আমাকে লিখেছিল যে ভিয়েনায় এত নতুন নতুন বিষয় থাকা সত্ত্বেও সে এখনো কি পরিমাণে বেনকাইসেরকে মনে করে। ‘আমি আমার প্রিয় লিজ এবং ওরফাত শহরে চলে আসার জন্যে তৈরি হয়ে আছি। তারপরেই নিচে আন্ডারলাইন করে লেখা’ অবশ্যই সেই শহরে যে শহরে স্টেফেনি বসবাস করে। বেনকাইসের সাথে আমার আবার দেখা হবে, সে এখন কি জানি করে।’

তার কয়েক সপ্তাহ পরেই অ্যাডলফ ভিয়েনা থেকে চলে এলো এবং তার সাথে দেখা করতে আমি রেল স্টেশনে চলে গেলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে তার ব্যাগ নিয়ে স্টেশন থেকে বেড় হতে হতেই অ্যাডলফ আমাকে স্টেফেনি সম্পর্কে যাবতীয় খবর জানতে চাইলো। আমরা একটু তাড়াতাড়িই হাঁটছিলাম কারণ আর ঘণ্টাখানেক বাদেই আমাদের বিকেলের ভ্রমণে বের হতে হবে। আর এদিকে অ্যাডলফ হয়তো এ কথা বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে স্টেফেনি তার অনুপস্থিতিতে তার কোনো খবর নেয়নি। কিন্তু অ্যাডলফ ধারণা করেছিল স্টেফেনি হয়তো তাকে দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে বসে আছে যেমনটা অ্যাডলফের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। তবে অ্যাডলফ এ কথা ভেবে খুবই আনন্দিত যে আমি তার ভবিষ্যত পারিকল্পনার কথাটা তখনও স্টেফেনিকে বলিনি। কেননা তার পরিকল্পনায় ভবিষ্যত জীবন যেমন হওয়ার কথা ছিল তেমনটি হতে পারেনি*। আমরা দ্রুত পায়ে হেটে হামবোল্ডস্ট্রেসে তাদের বাড়িতে যেয়ে অ্যাডলফের মায়ের সাথে দ্রুত দেখা করতে গেলাম। কেননা তারপরই আমাদের স্টেফেনির সাক্ষাতের আশায় স্কেমিয়েডটরেক এর পথে হাঁটা দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত গভীর উত্তেজনায় অ্যাডলফ আর আমি সেখানে স্টেফেনির অপেক্ষায় বসে রইলাম। নির্দিষ্ট সময়ে স্টেফেনি এবং তার মাকে দেখা গেল। স্টেফেনি দূরে অ্যাডলফকে দেখতে পেয়ে তার দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকাল। অ্যাডলফের জন্যে এটাই যথেষ্ঠ ছিল। কিন্তু আমার ধৈর্য যেন বাঁধ মানে না। আমি আমার বন্ধুটিকে বললাম, ‘আমার মনে হয় স্টেফেনি তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে।’ তার উত্তর, ‘ঠিক আছে, আগামীকাল বলবো’।

কিন্তু অ্যাডলফের জীবনে ‘আগামীকাল’ আর কখনো আসে না। বছর যায়, মাস যায়, সপ্তাহ যায় স্টেফেনির প্রতি তার গোপন প্রণয় ধীরে ধীরে  খুব যন্ত্রণার কাঁটা হয়ে থাকলো। এটা স্বাভাবিক যে অ্যাডলফের প্রতি স্টেফেনির যে প্রথম দৃষ্টি বিনিময় ঘটেছিল তা দিয়ে তেমন কিছু আশা করা যায় না। অ্যাডলফ সবচেয়ে বেশি যে স্মৃতিটাকে নিয়ে এখনো আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে তা হলো- ফুল উৎসবে স্টেফেনি এক গোছা ফুল তার দিকে ছুড়ে মেরেছিল। এই পর্যন্তই। এই স্মৃতিটাই অ্যাডলফ তার হৃদয়ে পোষণ করে রেখেছিল। এই ঘটনাটা শুধুমাত্র স্টেফেনির ক্ষেত্রে আরো অন্য কোন নারী জাতির মতোই মেয়েলি কোনো ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও তা অ্যাডলফের জীবনের ভবিষ্যত পারিকল্পনার জন্যে বড় একটি বিষয় হয়ে উঠেছিল। সে নিজেই এই বিষয়টা নিয়ে দেখভাল করছিল এবং তার এই ব্যর্থতার দায় খুব সূক্ষভাবে হলেও সে তা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।

অবশ্যই, স্টেফেনি দেখতে সুন্দরী এবং আরো হাজার নারীর মতোই সেও মনে প্রাণে সুখি এবং বয়সে তরুণী এক নারী। এই মেয়েকে না পাওয়ার বেদনায় অ্যাডলফ নীল হতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক। অ্যাডলফ কল্পনায় স্টেফেনি নামের এমন একটি নারীকেই সে তার জীবনের সাথে লেপ্টে রেখেছিল।

এ কথা সত্য যে যুবক অ্যাডলফ সেই সময়ের যাবতীয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে নিজেকে দাঁড় করাতে ভালোবাসতো এবং মধ্যবিত্তদের তৈরি করা সমাজকে ঘৃণার চোখে দেখতো, সেই যুবকের স্টেফেনির প্রতি অন্ধের মতো প্রেমে পড়াটা অনেকটাই চোখের পড়ার মতো এক ঘটনা। সেই সময়ে মধ্যবিত্ত সমাজের তৈরি করা কিছু নিয়ম নীতিমালা স্টেফেনির প্রতি গভীর ভালোবাসাতে অনেকটুকুই ব্যাহত করেছিল। ‘আফসোস! তার সাথে আমার এখনো কোনো পরিচয় হয়ে উঠেনি’- এই কথাটা আমি তার কাছ থেকে প্রায় সময়ই শুনতে পেতাম। যদিও সেই সময়ে সে খুব স্বাভাবিকভাবে সমাজের সব বাধাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সমাজের এই কঠিন নীতিমালা তার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক জীবনের অন্যতম একটা বাধা হয়ে রয়ে গেল। তার ভদ্র জামা কাপড়, শালীন ব্যবহার তা সবই ছিল তার প্রকৃতিগতভাবেই প্রাপ্ত। আমার মা এ জন্যে তাকে খুব ভালোবাসতো। আমি কখনো শুনিনি যে অ্যাডলফ এমন কোনো গল্প বলছে যা কিনা বোগাস এবং সন্দেহপূর্ণ।

সুতরাং এই সব ঝুট ঝামেলা থাকা সত্ত্বেও স্টেফেনির প্রতি অ্যাডললের এই অদ্ভুত ভালোবাসা তার চরিত্রকে অন্যরকম একটা পরিচিতি দিয়ে দিলো। ভালোবাসা এমন একটা বিষয় যেখানে অনেক অবদমিত শক্তির প্রকাশ ঘটে এবং যা মাঝে মাঝে ধ্বংসাত্মকও হয়ে ওঠে। এমন কত পুরুষ আছেন যারা তাদের ভালোবাসার ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে যে পথ দিয়ে হাঁটছিলেন তা শেষ পর্যন্ত জটিল প্রণয়ের আখ্যানে পরিণত হয়েছে।

যুবক হিটলার স্টেফেনির প্রতি ভালোবাসায় আসক্ত হয়ে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যা অর্জন করেছিল তা হলো, স্টেফেনিকে ভালোবাসতে যেয়ে ভালোবাসাকে অর্জন করা এবং পাশাপাশি স্টেফেনিকে হারানোর বেদনা। সে সারাজীবন এই বিশ্বাস করতো যে, সে যাকে ভালোবেসেছিল সেই নারীটি একান্তই তার হয়েই থাকবে। কিন্তু যেহেতু সে ব্যাক্তিগত স্বভাব অনুযায়ী স্টেফেনির মুখোমুখি হতে পারতো না সে কারণে সে স্টেফেনিকে তার কল্পনায় বসিয়ে নানাভাবে দেখতে পেত। তার সেই স্বপ্ন শুধুমাত্র স্বপ্নেই রয়ে গেল। সে কারণে সে সব সময় তার ব্যক্তিগত ভাবনা এবং চিন্তাকে স্টেফেনি নামের এই নারীর প্রতি তার যে ভালোবাসা সেই ভালোবাসকে তার ব্যক্তিজীবনের নানান অনুসর্গ থেকে আলাদা করে রাখলো। সে কল্পনায় ভাবতো স্টেফেনি তার স্ত্রী, সে সুন্দর একটি বাড়ি তৈরি করছে যেখানে সে স্টেফেনিকে নিয়ে সুখের জীবন কাটাবে, যে বাড়িটার চারপাশে সুন্দর ফুলের বাগান থাকবে আর সেই বাগানে স্টেফেনিকে নিয়ে তার ভালোবাসার সময় কাটবে। সত্যি বলতে তার কল্পনায় বিচরণ করা এমন একটি বাগান সে সত্যি সত্যি ওবারসালবার্গ শহরে বানিয়েছিল, যদিও সে বাগানটিতে তখন স্টেফেনি ছিল না। এই স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মিশ্রণই হল একজন যুবক হিটলারের প্রতিকৃতি। যে কারণে যখনই হিটলারকে কোন দুঃসময় পাড়ি দিতে হয়েছে অথবা কোনো স্মৃতি তাকে তাড়িত করেছে সে স্কেমিয়েডটরেক এর এই স্মৃতিঘেরা পার্কে চলে এসেছে এবং কল্পনায় স্টেফেনিকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছে। হিটলার তার জীবনে বাস্তব স্টেফেনিকে যত না ভালোবাসতো তার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে তার কল্পনায় আগলে রাখা নানান রঙে আঁকা স্টেফেনিকে দেখতে। অতএব হিটলারের জীবনে স্টেফিনির উপস্থিতিকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হল বাস্তবতা এবং দ্বিতীয়টি হল কল্পনা। অতএব শেষ কথা এই বলা যায় যে স্টেফেনি ছিল হিটলারের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর, সুচারু এবং পবিত্রতম এক স্বপ্ন।

* হিটলার, ভিয়েনায় একাডেমি অব আর্টস এ ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেনি এবং চারুকলা নিয়ে তার উচ্চতর পড়াশুনাও আর হয়ে ওঠে না। সে কারণে সে দ্রুত আবার ভিয়েনা ছেরে তার লিজ শহরে চলে আসে।

পর্ব ২১


ঘোড়ার গাড়ি থেকে স্টেফেনির হাত থেকে ফুলের তোড়া পাওয়ার পর অ্যাডলফ যেভাবে আনন্দ সাগরে ভেসেছিল সত্যি বলতে আমি অ্যাডলফের চোখে সেই আনন্দের জোয়ার আর কখনোই দেখিনি। স্টেফেনিকে বহন করে নিয়ে আসা ঘোড়ার গাড়িটি আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই অ্যাডলফ আবেগের চোটে আমাকে টান দিয়ে ধরে রাস্তার একটা পাশে নিয়ে এলো এবং গভীর ভালোবাসায় ফুলগুলোকে জড়িয়ে ধরলো। আমি তার কণ্ঠস্বর এখনো যেন শুনতে পাই। আনন্দ আর উত্তেজনায় সে আমাকে বলছে, ‘সে আমাকে ভালোবাসে! দেখেছ! সে আমাকে কত ভালোবাসে!’
পরবর্তী মাসে অ্যাডলফ যখন তার স্কুল ছাড়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছিল এবং এই নিয়ে তার মায়ের সাথে মনোমালিন্য হচ্ছিল তখন সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং সেই কঠিন সময়ে তার বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল স্টেফেনির ভালোবাসা। সে অনেক যত্ন নিয়ে স্টেফেনির দেওয়া ফুলের তোড়াটি তার গোপন একটা বাক্সে রেখে দিয়েছিল। সেই সময় অ্যাডলফের কোনো বন্ধুর প্রয়োজন ছিল না কারণ আমিই তার একমাত্র বন্ধু যার কাছ থেকে সে নিয়মিতভাবে স্টেফেনির সব গোপন খবর পেয়ে যেত। আমাকে প্রতিদিন সেই একই জায়গায় যেখানে স্টেফেনিকে দেখতে পাওয়া যায় সেখানে যেতে হতো এবং তার সম্পর্কে বিশদ খবর সংগ্রহ করে তাকে দিতে হতো। বিশেষ করে স্টেফেনির সাথে অথবা তার মায়ের সাথে অন্য কারো কোনো কথা হয়েছিল কিনা অথবা কারো কোনো উপস্থিতি ছিল কিনা সে খবরটি তাকে আমাকে নিয়ম করে জানাতে হতো। যেহেতু অ্যাডলফ অসুস্থ তাই তাকে ছাড়াই আমি যখন আমাদের সেই পরিচিত জায়গাটিতে স্টেফেনির জন্যে অপেক্ষায় থাকবো তা দেখে স্টেফেনি হয়তো মন খারাপ করবে। অ্যাডলফ সেরকমটাই ভেবেছিল। কিন্তু স্টেফেনির ক্ষেত্রে এমন কোনো ঘটনা ঘটলো না এবং তা আমি অ্যাডলফের কাছে গোপন রেখেছিলাম। ভাগ্যক্রমে ঘুনাক্ষরেও অ্যাডলফের মনে কখনোই এমন সন্দেহ বাসা বাঁধেনি যে আমি স্টেফেনির খোঁজ নিতে যেয়ে আবার নিজেই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছি! বন্ধুত্বের চির ধরতে পারে এ জন্যে এই সন্দেহই যথেষ্ট ছিল। আমি অবশ্য আমার প্রিয় বন্ধুটিকে স্টেফেনি সম্পর্কে সব রকম তথ্যই নিয়মিত সরবারহ করছিলাম।
অ্যাডলফের মা দীর্ঘদিন ধরেই তার পুত্রের এই ধরনের পরিবর্তন সম্পর্কে অবগত ছিলেন। আমি বিষয়টি বেশ জোরালোভাবে মনে করতে পারছি এ কারণেই যে বিষয়টি আমাকেও বিব্রত করেছিল। একদিন অ্যাডলফের মা আমাকে সরাসরিই প্রশ্ন করলেন: ‘অ্যাডলফের কী হয়েছে? সে তোমাকে দেখার জন্যে পাগলের মতো হয়ে থাকে?’ আমি তার এ ধরনের প্রশ্নবানে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম এবং দ্রুত অ্যাডলফের কক্ষে প্রবেশ করে সে যাত্রায় নিজেকে রক্ষা করেছিলাম।
অ্যাডলফ সবসময় খুব খুশি হতো যখন আমি তার জন্যে স্টেফেনি সংক্রান্ত কোনো খবর নিয়ে আসতে পারতাম। ‘তার কণ্ঠস্বর অনেক মিষ্টি আর মোলায়েম’। একদিন আমি এই কথাটা অ্যাডলফকে বলতেই সে তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠলো। চোখ কপালে উঠিয়ে সে আমাকে বললো, ‘তুমি তা জানলে কীভাবে দোস্ত!’ আমি তাকে খুব কাছে থেকে অনুসরণ করতাম এবং সে যখন কথা বলতো তখন খুব কাছ থেকে তার কণ্ঠ আমি শুনতে পেরেছিলাম। সঙ্গীত সম্পর্কে আমার অনেক অভিজ্ঞতা থাকায় আমি কারো কণ্ঠ শুনলেই বলে দিতে পারতাম যে সেটি সুরেলা বা মিষ্টি কিনা। এ কথা শুনে অ্যাডলফের আনন্দ যেন ধরে না! কতই না সুখি দেখাতো তাকে! আমার এটা দেখে খুব ভালো লাগতো যে সয্যাশায়ী হয়ে কেউ অন্তত এক মুহূর্তের জন্যে হলেও সুখি হতে পেরেছে।
প্রতি বিকেলেই আমি হামবোল্ডস্ট্রের যে বাড়িটায় অ্যাডলফ থাকে সে বাড়িতে যাওয়ার শর্টকাট যাওয়ার পথটার দিকে পা বাড়াতাম। প্রায় সময়ই আমি দেখতে পেতাম অ্যাডলফ আপন মনে নিজেই একটি বাড়ির নকশা আঁকায় নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। ‘আমি এখন আমার মনস্থির করে ফেলেছি।’ আমার কাছ থেকে ব্যাগ্রভাবে স্টেফেনির খবর শোনার পর সে বললো। ‘আমি ঠিক করেছি আমি এই বাড়িটা স্টেফেনির জন্যে রেনেসাঁর স্টাইলে তৈরি করে দেব।’ তারপর আমাকে এই বিষয়ে একটা মতামত দিতে হতো। বিশেষ করে সে বাড়িটার সঙ্গীত কক্ষটি কেমন হবে এবং কীভাবে হবে এই নিয়ে। সে এই কক্ষটিতে পিয়ানোটি কোন দিকে বসবে বা বসালে ভালো হবে এই নিয়ে আমাকে মত দিতে হতো। তার বক্তব্যগুলো এমনভাবেই পেশ করা হতো যে পরিকল্পনা মতো বাড়ি সে করতে পারবে কি পারবে না এই নিয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকতো না। এমন বাড়ি করতে টাকা কোথায় পাবে? এ ধরনের প্রশ্ন শুনলেই সে রাগে চিৎকার করে বলে উঠতো, ‘ওহ! টাকা দোজখে যাক।’ যেমনটা সে সবসময় টাকার বিষয় উঠলেই এভাবে বলে থাকতো।
বাড়িটা কোথায় তৈরি হবে এই নিয়ে আমাদের দু বন্ধুতে বেশ তর্ক-বিতর্ক হতো। একজন সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে আমার প্রথম পছন্দের জায়গা ছিল ইতালি। কিন্তু অ্যাডলফের মত ছিল এটি অবশ্যই জার্মানিতে হবে এবং কোনো শহরের উপকণ্ঠেই হবে। কারণ তাতে সে এবং স্টেফেনি দুজনেই সপ্তাহান্তে অপেরা এবং নাটক দেখতে যেতে পারবে।
অ্যাডলফ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুস্থ হয়ে উঠেই দ্রুত স্কিমিয়েডটরে পথে  স্টেফেনিকে দেখার জন্যে ঠিক সময়ে চলে গেল। তখনও সে খুব রুগ্ন এবং শারীরিকভাবে খুব দুর্বল। স্টেফেনি এবং তার মাকে দেখা গেল। অ্যাডলফের রোগা পাতলা চেহারা আর গর্তে যাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে স্টেফেনি মুচকি হাসলো। ‘তুমি কী লক্ষ্য করেছ?’ সে আমাকে আনন্দের সাথে প্রশ্ন করলো। সেই সময় থেকে তার শরীর দ্রুত ভালো হতে শুরু করলো।
১৯০৬ সালে অ্যাডলফ ভিয়েনা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সে আমাকে বিশদভাবে একটি নির্দেশনা দিয়েছিল যে কীভাবে আমি স্টেফেনির সাথে কথা বলবো এবং তার কথার উত্তর দেব। তার ধারণা ছিল স্টেফেনি হয়তো খুব শিগগিরই আমাকে একা থাকতে দেখে অ্যাডলফের শারীরিক অবস্থা নিয়ে খোঁজ-খবর জানতে চাইবে এবং এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে। তখন আমাকে যে উত্তর দিতে হবে তা হলো: আমার বন্ধু অসুস্থ নয়। কিন্তু তাকে একাডেমি অব আর্টসে উচ্চতর পড়াশোনার জন্যে ভিয়েনায় যেতে হয়েছে। যখন তার পড়াশোনা শেষ হয়ে যাবে তখন সে এক বছরের জন্যে দেশের বাইরে লম্বা ছুটি কাটাতে চলে যাবে। আমি অবশ্য তাকে দেশের বাইরে না বলে ‘ইতালি’ বলতে বলেছিলাম। ‘ইতালি?’ ঠিক আছে তাই হোক। বলবে ইতালিতে এক বছরের জন্যে ছুটি কাটাতে চলে যাবে। এবং চার বছরের মধ্যেই সে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। তার কাছ থেকে হ্যাঁ বোধক কোনো উত্তর আসার সাথেই সাথেই বিয়ের সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে ফেলতে হবে।

পর্ব ২০

সপ্তম অধ্যায়
স্টেফিনির নাচের বিষয়ে অ্যাডলফের অতিরিক্ত চিন্তার কারণে গোটা বিষয়টি নিয়ে সে যেনো তালগোল পাকিয়ে ফেলছিল। আমি বরং এই শঙ্কাই করছিলাম, অ্যাডলফ হয়তো স্টেফেনিকে পাওয়ার জন্য গোপনে তার ছোটবোনের সঙ্গে নাচের প্রশিক্ষণে নেমে গেছে। হিটলারের মা বাড়িতে তার জন্য একটি পিয়ানো কিনে এনেছেন। ভাবছি, খুব শিগগিরই হয়তো সেখানে আমার ওয়ালজ বাজানোর ডাক পড়বে এবং অ্যাডলফ যখন পিয়ানোর তালে তালে নাচবে তখন সেই দৃশ্যটিও আমাকে বোকার মতো হজম করতে হবে। অবশ্য নাচের জন্য অ্যাডলফের সঙ্গীতের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি অ্যাডলফকে সঙ্গীতের তালের সঙ্গে শারীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর যে সুন্দর একটি সুরময় যোগসূত্র রয়েছে সে কথাটি বলতে চেয়েছিলাম। বলাইবাহুল্য এই বিষয়ের উপর সম্ভবত তার কোনো ধারণাই নেই।
কিন্তু বিষয়টা এতো ভাবার পরও খুব বেশিদূর পর্যন্ত এগুতে পারেনি। অ্যাডলফ দিন-রাত এই নিয়ে ভাবতো এবং এর একটা সুন্দর সমাধানের পথ খুঁজতে নিজেকে ব্যস্ত রাখতো। অ্যাডলফের চিন্তা-ভাবনার এই জটিল সময়ে সে একটি পাগলাটে সিদ্ধান্ত হাতে নিলো। সে স্টেফেনিকে কিডন্যাপ করার মতলব আঁটলো। পুরো বিষয়টা নিয়ে আমার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করলো এবং এ কাজ করতে আমার যা যা করণীয় কাজ থাকবে তা বুঝিয়ে দিলো। বিষয়টা আমার জন্য মোটেও সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না। আমার দায়িত্ব হলো, অ্যাডলফ যখন স্টেফেনিকে কিডন্যাপ করবে সেই মুহূর্তটা তার মাকে কথাবার্তা এবং আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত রাখা। ‘কিডন্যাপ যে করবে তারপর তোমরা দু’জন থাকবে কোথায়?’ আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্নটি করলাম। আমার কথা শুনে তাকে কিছুক্ষণের জন্য চিন্তাযুক্ত দেখা গেলো এবং এই সাহসী পরিকল্পনাটাই সে ভেস্তে দিলো।
কপাল খারাপ থাকলে যা হয় সেসময় স্টেফেনির মেজাজটাও খুব ফুরফুরে ছিলো না। সে যখন স্কিমিয়েডটোরেক অতিক্রম করতো তখন এমনভাবে হাঁটতো এবং ভাব করতো যে, অ্যাডলফ নামের কেউ যেনো তার আশেপাশে নেই। স্টেফেনির এই অবজ্ঞা অ্যাডলফকে আরো বেশি জেদি করে তুললো। ‘আমি আর এটি নিতে পারছি না। আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।’ অ্যাডলফ চিৎকার করে কথাগুলো আমাকে শোনাতো।
যতদূর মনে পড়ে, সেটিই ছিলো অ্যাডলফের প্রথম এবং শেষ আত্মহত্যা করার প্রচেষ্টা। পরিকল্পনাটা আমাকে সে জানিয়েছিল। সে দানিয়ুব নদীর উপর যে ব্রিজটি রয়েছে সেখান থেকে লাফিয়ে পড়বে এবং এভাবেই জীবনের ইতি টানবে। কিন্তু স্টেফেনিকেও তার সঙ্গে মরতে হবে। সে নিজেও ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দেবে, স্টেফেনিকেও তার সঙ্গে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করবে। অ্যাডলফ এ কথাটাও যোগ করলো। পরিকল্পনা অ্যাডলফের মনে তখন পায়চারি করছিল। তার প্রতিটা ভয়ংকর পরিকল্পনার সঙ্গে আমাকেও সে যুক্ত করতো এবং তখন আমার কী ভূমিকা থাকবে সেটাও সে আমাকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখতো। যেহেতু আমি বেঁচে থাকবো তাই বিষয়টা আমাকে খুব যন্ত্রণা দিত। এমনকি স্বপ্নেও বিষয়টা আমাকে ভাবাতো।
কিন্তু খুব শিগগিরই আকাশ আবার নীল হলো। এবং অ্যাডলফের জন্য সবচেয়ে সুখের একটি দিন এলো। সেটি ছিলো ১৯০৬ সাল। আমি নিশ্চিত এই স্মৃতিটুকু অ্যাডলফও নিশ্চয় ঠিক আমার মতোই তার স্মৃতিতে বহন করে চলেছে। লিজ শহরে শুরু হলো বসন্ত উৎসব। বরাবরের মতো অ্যাডলফ আমার জন্য কারমেলাইট চার্চের সামনে অপেক্ষা করছিল। প্রতি রোববার আমি আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে এই চার্চে যেতাম এবং সেখান থেকে স্কিমিয়েডটোরেকে স্টেফেনিকে দেখার আশায় আমরা দু’জনেই আমাদের অবস্থান নিতাম। অবস্থানগত কারণে এটি আমাদের জন্য সুবিধার ছিলো এ কারণেই যে, স্কিমিয়েডটোরেকের ঢালটি অনেক নিচু ছিলো এবং যেখানে বসন্ত উৎসব চলছিল সেখান থেকে তা খুব কাছেই। সেখানে ফুলের দোকানে সুশ্রী সুন্দরী তরুনী এবং মহিলারা ফুল নিয়ে আনন্দ উৎসবে মেতে আছে। কিন্তু এডলফের এসব দেখার না আছে চোখ আর না আছে কান। তার চোখ শুধু কখন স্টেফেনি আসবে সেই আশায় যেনো সময় গুনছে। আমিও ইতোমধ্যে স্টেফেনির দেখা পাওয়ার সবরকম সম্ভাবনা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ অ্যাডলফ আমার বাহুতে এমন শক্ত করে চাপ দিলো যে আমি ব্যথায় চিৎকার করে দেওয়ার অবস্থা। আমরা দু’জনেই আবিষ্কার করলাম ফুল দিয়ে সাজানো সুন্দর একটি ঘোড়ার গাড়িতে স্টেফেনি ও তার মা বসে আছে এবং তারা দু’জনেই যেনো স্কিমিয়েডটোরেকের দিকেই আসছে। সেই দৃশ্যটির কথা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। হালকা ধূসর রঙের একটা গাউন আর মাথায় একটি গোলাপি রোদ নিবারক টুপি পরে স্টেফেনির মা এমনভাবে বসে রয়েছে যেনো গোটা এলাকায় তার সেই বসন্তের আভাটি ছড়িয়ে পরেছে। সিল্কের একটি জামা পরা স্টেফেনির হাত ভরে আছে লাল রঙের পপি, কিছু গোলাপ আর নীল রঙের ফুলকপির ফুল। সেই ফুলের আভায় বসন্ত যেনো আরও বন্য হয়ে সেখানে ধরা পড়েছিল। স্টেফেনি এবং তার মাকে বহন করা ঘোড়ার গাড়িটা যখন আমাদের দিকে আসছিল তখন অ্যাডলফ যেনো আনন্দে বাতাসে ভাসছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেনো এমন দৃশ্য তার জীবনে আর কখনই দেখেনি। তাদের ঘোড়ার গাড়িটা আমাদের খুব কাছেই চলে এলো। অ্যাডলফ এবং স্টেফেনির মায়াবী দৃষ্টি বিনিময় হলো। স্টেফেনি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো এবং আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে সঙ্গে রাখা ফুলের ঝুড়ি থেকে একটি ফুল অ্যাডলফের দিকে ছুড়ে মারলো।

পর্ব ১৯

সপ্তম অধ্যায়
আমি অনেক দিন ধরেই ভেবেছিলাম যে, অ্যাডলফ লজ্জার কারণেই স্টেফেনির সামনে গিয়ে সরাসরি কোনো প্রস্তাব দিতে পারছে না। কিন্তু তারপর দেখা গেলো ওটা লজ্জার কারণে নয়। প্রেম, ভালোবাসা আর সম্পর্ক নিয়ে সে যেভাবে চিন্তা করে তা অন্যদের মতো নয়। দুজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মধ্যে গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় যে প্রণয়ের জন্ম হয় তা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। যেহেতু সে এই গতানুগতিক উপায়ে কোনো নারীর প্রণয় ভিক্ষায় তার কোনো বিশ্বাস নেই, সে কারণেই সে কখনও স্টেফেনির সামনা-সামনি দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করেনি। তার ভাবনা ছিলো, স্টেফেনিই হয়তো একদিন তার কাছে এসে তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেবে।  আমি এই বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কখনও কোনো কথা বলতে চাইতাম না কিন্তু যেহেতু যেকোনো বিষয় নিয়েই অ্যাডলফের খুব গভীরভাবে ভাবার একটা অভ্যাস রয়েছে, সে কারণে এই বিষয়টি নিয়েও অ্যাডলফ একটি ভবিষ্যত পরিকল্পনার ছক কেটে ফেললো। যেহেতু মেয়েটি অ্যাডলফের কাছে তখনও পর্যন্ত অপরিচিতা, যার সঙ্গে কোনো বাক্য বিনিময় তখন পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। সেই মেয়েটির জন্য পারিবারিক শিক্ষাবঞ্চিত এবং সব দিক থেকে অকৃতকার্য এই যুবকটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আঁটতে মগ্ন হয়ে গেলো। দীর্ঘ চার বছর পর বিভিন্ন পরিকল্পনা এঁটে সে স্টেফেনির হাত ধরার জন্য অবশেষে মুখ খুলেছিল।
আমরা বিষয়টির আপাত সমস্যা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছি, যেহেতু অ্যাডলফ আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল, স্টেফেনি সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য যোগাড় করে দিতে। মিউজিক সোসাইটিতে যে ছেলেটি সিলি বাজায় তাকে মাঝেমধ্যেই স্টেফেনির ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। তার কাছ থেকেই আমি জানতে পেরেছিলাম, স্টেফেনির বাবা ছিলেন একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা যিনি কয়েক বছর আগেই মারা যান। তার মায়ের রয়েছে একটি সুন্দর বসবাস উপযোগী বাড়ি আর বিধবা হিসেবে সরকারি পেনশনও তিনি নিয়মিতভাবে পেয়ে আসছেন যা তিনি তার দুই সন্তানের উপযুক্ত আর ভালো শিক্ষার জন্য ব্যয় করছিলেন। স্টেফেনি তখন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে ইতোমধ্যেই মেট্রিক পাশ করে ফেলেছে। সুন্দরী হওয়ার কারণে তার আশেপাশে ভক্তের সংখ্যা নেহায়েত কম ছিলো না। নাচ হলো তার প্রিয় একটি সখ এবং গত শীতে সে তার মায়ের সঙ্গে শহরের সব বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ নাচের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল। সিলিস্ট এর তথ্য অনুযায়ী, স্টেফেনির সঙ্গে তখনও কারও বাগদান হয়নি।

অ্যাডলফ আমার এই অনুসন্ধানে অনেক খুশি হয়েছিল এই ভেবে, আর যাইহোক স্টেফেনি এখনও কাউকে কোনো কথা দিয়ে ফেলেনি। এবং সম্ভবত এই শূন্যস্থানটি অ্যাডলফকেই পূরণ করতে হবে। স্টেফেনির উপর আমার অনুসন্ধানে শুধু একটি বিষয় অ্যাডলফ পছন্দ করতে পারেনি। আর তা হলো, স্টেফেনি নাচ ভালোবাসে। শুধু নাচ সে ভালোবাসে তাই নয়, সে নিজেও খুব ভালো নাচিয়ে এবং নাচকে উপভোগ করে। এই বিষয়টি অ্যাডলফেরর নিজস্ব চিন্তা আর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একেবারেই যাচ্ছিল না। ভাবা যায়, বলরুমে একজন মাথামোটা লেফটেন্যান্টের কাঁধে হাত দিয়ে স্টেফেনি নাচছে! দৃশ্যটি ভাবতে অ্যাডলফের জন্য মোটেও সুখকর কিছু ছিলো না।
কী সেই পেছনে ফেলে আসা যন্ত্রণার ইতিহাস যা অ্যাডলফকে এমন করে ভাবতে তৈরি করে দিলো। কেন সে স্বভাবসুলভ তারুণ্যের প্রকাশকে মেনে নিতে পারছে না? অ্যাডলফের বাবা যিনি নিজেও দেখতে সুদর্শন ছিলেন এবং তার কাজ নিয়ে বেশ আনন্দেই মেতে থাকতেন। তিনিও নিশ্চয়ই অনেক নারীর স্পর্শে এসেছিলেন? তাহলে অ্যাডলফ এমন হলো কেন? দেখতে সে মন্দ নয়, শারীরিকভাবে সুগঠিত, সুঠাম, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা আর সেইসঙ্গে রয়েছে তার অসাধারণ আকর্ষণ করার মতো দু’টো চোখ। সে বারে গিয়ে মদ খাওয়া আর সেইসঙ্গে নাচগান পছন্দ করতো না। এটা ছিলো তার চরিত্রের বিরুদ্ধে। এই বিষয়গুলো তার চরিত্রে সম্পূর্ণভাবেই অনুপস্থিত ছিলো। উপরন্ত তার মা-ও তাকে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে এবং তার মনের অবস্থা পরিবর্তন করাতে কখনও কোনো উৎসাহ যোগাতো না।
বিষয়টি অনেকদিন পর্যন্ত এইভাবে ঝুলে থাকার পর শেষপর্যন্ত আমিই তাকে পরিবর্তন করার জন্য তার পিছু নিলাম। আমি অ্যাডলফের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি বললাম, ‘অ্যাডলফ, তোমার অবশ্যই নাচ শেখা উচিত’। কিন্তু নাচের বিষয়টি তার জন্য খারাপ ফল নিয়ে এলো। আমার পরিষ্কার মনে আছে, এই বিষয়গুলোর কারণে অ্যাডলফের সঙ্গে আমার থিয়েটার নিয়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক হতো না বা দানিয়ুব নদীর উপরের ব্রিজ নিয়ে নতুন করে আর কোনো আলোচনায় বসা হতো না। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিলো তখন একটাই, ‘নাচ’।
যেমনটি তার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সে কখনও সবকিছুকে একসঙ্গে দেখতে পারতো না। অনেক সময় বিষয়কে সরলীকরণ করতে সে বাধ্য করতো। ‘কল্পনায় একটি ব্যস্ত বলরুমের কথা ভাবো। যেখানে অনেক নর-নারী গানের তালে তালে নাচছে।’ সে আমাকে একদিন এভাবেই কথাটা বলেছিল। সে যোগ করলো, ‘আর কল্পনায় ভাবো যে, তুমি সেখানে এক বধির। কোনো কথা বলতে পারো না। আর তুমি কোনো গানও শুনতে পাচ্ছ না। এবার তুমি লোকগুলোর কাণ্ডজ্ঞানহীন শরীরটার দিকে তাকিয়ে দেখ। তাদের শরীরটা বোকার মতো দুলছে। তোমার কি মনে হয় না, লোকগুলো আস্ত বন্য আর পাগল ছাড়া আর কিছুই নয়?’
‘অ্যাডলফ, আমি জানি এসব ভালো নয়’। আমি উত্তর দিলাম। ‘কিন্তু স্টেফেনি নাচ ভালোবাসে। তুমি যদি স্টেফেনিকে চাও তাহলে তোমাকেও অন্যদের মতোই তার সঙ্গে নাচতে হবে। তোমাকে এই বন্য কাজটুকু করতে হবেই।’ ‘না, না, তা কখনই সম্ভব নয়।’ সে আমাকে চিৎকার করে বললো। তারপর যোগ করলো, ‘আমি কখনই নাচবো না! তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না! স্টেফেনি নাচে কারণ, সমাজ তাকে এইভাবে তৈরি করেছে। কারণ, এই সমাজের উপর সে নির্ভরশীল। যখন সে আমার স্ত্রী হবে তখন নাচের প্রতি তার কখনই আর কোনো আগ্রহ থাকবে না’। 

পর্ব ১৮


সপ্তম অধ্যায়
আমার ঠিক মনে পড়ে না অ্যাডলফ অন্যকোনো নারীর প্রতি কখনও তার আগ্রহ দেখিয়েছিল। তার কাছে স্টেফেনি ছিলো গোটা নারী জাতির প্রতিবিম্ব। পরবর্তীতে ভিয়েনায় লুসি উইড তার লুহেনগ্রিনে এলসা চরিত্রটি যখন রূপ দেয় তখন সেই মায়াবতী নারীটি অ্যাডলফের কাছে স্টেফেনি রূপেই ধরা পড়েছিল। স্টেফেনি নিজেও তার শারীরিক সৌন্দর্য বিবেচনায় এলসা এবং ওয়াগনার অপেরার অন্যন্য নারী চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে ছিলো। আমরা দু’জনেই খুব আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষায় ছিলাম, স্টেফেনির নাটকের সেরকম নায়িকাদের মতো কণ্ঠ বা সঙ্গীতের উপর কোনো দক্ষতা রয়েছে কিনা। অ্যাডলফ বিষয়টাকে খুব গর্বের সঙ্গেই দেখতো। তার দেবীতুল্য চেহারার কারণে অ্যাডলফ কখনও তার দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারতো না। সে স্টেফেনিকে উদ্দেশ্য করে অগনিত প্রেমের কবিতা লিখেছিল। ‘প্রিয়ার জন্যে কবিতা’ এই শিরোনামে সে কয়েকটি কবিতা তার ছোট কালো নোট বইটায় লিখে আমাকে শুনিয়েছিল। তার কবিতাগুলো ছিলো-
‘স্টেফেনি, সম্ভ্রান্ত এক রমনীর নাম/গভীর নীল ফুলেল গাউনে ঢেকে আছে তার কোমল শরীর/ পিঠে তার  ঢেউ খেলানো অদম্য এক রাশ খোলা সোনালি চুল/ পেছনে দাঁড়িয়ে আছে পরিষ্কার বসন্তের রঙ আর নীল আকাশ/ সবকিছু কতোইনা পবিত্র/ আহা! কী অনাবিল আনন্দ!’
আমি এখনও স্পষ্ট অ্যাডলফের আনন্দ উজ্জ্বল মুখটা দেখতে পাই। কতো আনন্দ আর উৎসাহেই না সে তার প্রেমিকাকে লেখা কবিতাগুলো আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলো। স্টেফেনি নামের মেয়েটি অ্যাডলফের চিন্তা এবং মননে সার্বক্ষণিক এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিল যে, তার ভবিষ্যত জীবনের সবকিছু শুধু তাকে কেন্দ্র করেই ভাবতে ভালোবাসতো। অ্যাডলফের বাড়িতে বৈরি পরিবেশ থাকা সত্যেও স্টেফেনি তখন আমার বন্ধুটির জীবনের এক বিশেষ জায়গা দখল করে নিয়েছিল। যদিও অ্যাডলফ তখন পর্যন্ত তার প্রেমে পড়ার বিষয়টি স্টেফেনিকে খোলামেলাভাবে বলতে পারেনি।
আমার ধারণায় স্টেফেনিকে নিয়ে এমন ভাবনা হওয়াটা ছিলো অ্যাডলফের জন্যে খুব স্বাভাবিক বা গতানুগতিক। এবং আমার স্পষ্ট মনে আছে, অ্যাডলফের সঙ্গে স্টেফেনির সম্পর্ক নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে যে কথাবার্তা হতো তাও ছিলো অনেকটা একই রকমের। তবে অ্যাডলফ আমাকে যে বিষয়টা সবসময় বোঝানোর চেষ্টা করতো তা হলো, একবার সে যখন স্টেফেনির মুখোমুখি হবে তখন কোনো বাক্য বিনিময় ছাড়াই তাদের দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। তার কথা হলো, যেহেতু সে এবং স্টেফেনি দু’জনেই মানুষ হিসেবে অন্যদের থেকে আলাদা তাই তাদের পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মুখ থেকে উচ্চারিত কোনো শব্দ খরচ করার প্রয়োজন নেই। দু’জন পাশাপাশি মুখোমুখি হয়ে বসলে চোখে চোখেই সব কথা বলা হয়ে যাবে। বিষয় যাই হোক না কেন অ্যাডলফ বিশ্বাস করতো, স্টেফেনি তার অন্তরাত্মার সব খবরই রাখে এবং সেও ঠিক তার মতো করে তাকেই শুধু ভাবছে। আমি যদি কখনও তার এই ছেলেমিসুলভ আচরণের সমালোচনা করতাম, বিশেষ করে সে যখন স্টেফেনির সঙ্গে কোনো বাক্যই বিনিময় করেনি- সেক্ষেত্রে সে আমার উপর রেগে যেতো এবং চিৎকার করে বলতো, ‘বিষয়টা নিয়ে তোমার বোঝার কোনো ক্ষমতাই নেই। কারণ, তুমি সত্যিকারের গভীর ভালোবাসার সংজ্ঞাটি জানো না।’ তাকে শান্ত করার জন্যে আমি তাকে শুধু স্টেফেনির মুখোমুখি হতে বলতাম। তাকে বলতাম, সে যদি তার এই অসাধারণ ভালোবাসা সম্পর্কে এতোই নিশ্চিত থাকে, তাহলে তার সেই জ্ঞানটি আত্মিকভাবেই সে স্টেফেনির ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে না কেন? তার উত্তর ছিলো, ‘এটা সম্ভব!। এই বিষয়গুলোর কোনো ব্যাখ্যা নেই। আমার মধ্যে যা আছে তা একইভাবে স্টেফেনির হৃদয় মন্দিরেও বসবাস করে’। অবশ্যই আমি এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে খুব বেশি একটা ঘাঁটতে চাইতাম না। তবে আমার ভালো লাগতো এই ভেবে যে, অ্যাডলফ আমাকে সবসময় বিশ্বাস করতো কেননা তখন পর্যন্ত সে কারও সঙ্গেই এমনকি তার মায়ের সঙ্গেও স্টেফেনিকে নিয়ে কোনো মুখ খোলেনি।
সে স্টেফেনির কাছ থেকে যা আশা করতো তা হলো, সে স্টেফেনিকে নিয়ে যেমন ভাবে, স্টেফেনিও যেনো তাকে নিয়ে সেই একইরকম চিন্তায় মগ্ন থাকে। অনেক দিন ধরে সে এটাও ভাবতো, স্টেফেনির হয়তো অন্য কোনো যুবক বা কোনো যুবক সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন দেখা গেলো অ্যাডলফের পরবর্তে স্টেফেনি একজন লেফটেন্যান্টের হাত ধরে ঘুরছে তখন স্টেফেনির প্রতি অ্যাডলফের হিংসার পরিমাণ আরও বেড়ে গেলো। কেন এই সুন্দরী যুবতীটি তার গোপন ভালোবাসার পাণিপ্রার্থী মানুষটাকে দেখতে পেলো না? তাহলে কী তার অন্য ভালোবাসার পাণিপ্রার্থীরা অ্যাডলফের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় ছিলো?  অবশ্যই আমি আমার এই ভাবনাগুলো কখনও অ্যাডলফের সামনে প্রকাশ করতাম না।
একদিন সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি এখন কী করতে পারি?’ সে আমার কাছে কখনও কোনো উপদেশ চায়নি। এবং এই প্রথমবার সে আমার উপদেশ চাওয়ায় আমি খুব গর্ব অনুভব করলাম। অন্তত এই পর্যায়ে তার চেয়েও ঢের বেশি জ্ঞানী হিসেবে নিজেকে ভেবে এক ধরনের সুখ অনুভব করলাম। ‘এটা কোনো বিষয়ই না। খুব সাধারণ’। আমি তাকে ব্যাখ্যা দিলাম। ‘তুমি মাথার টুপিটা কায়দা করে খুলে ওই দু’জন নারীর সামনে গিয়ে দাঁড়াও। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুমি তার মায়ের কাছে তোমার নামটা বলো। তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তার মেয়েকে সম্বোধন করো এবং তার দিকে এগিয়ে যাও।’আমার এই কথা শুনে অ্যাডলফ আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো এবং খুব গভীরভাবে বিষয়টা বিবেচনা করলো। শেষ পর্যন্ত সে আমার উপদেশ বর্জন করে আমাকে বললো, ‘স্টেফেনির মা যদি আমার পেশা সম্পর্কে জানতে চান তখন তাকে আমি কী বলবো? শেষ পর্যন্ত আমাকে আমার পেশার কথা তাকে বলতেই হবে। ভালো হয় যদি আমি আমার নাম এইভাবে উচ্চারণ করি- অ্যাডলফ হিটলার, পেশাদার চিত্রকর বা এমন কোনো ধরনের কিছু। কিন্তু আমি তো কোনো পেশাদার ছবি আঁকিয়ে নই। এবং আমি তা বলতেও চাই না যতোক্ষণ না পর্যন্ত আমি তা হতে পেরেছি। আবার সব মায়ের কাছে পেশা সবসময়ই নামের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে’।

পর্ব-১৭

সপ্তম অধ্যায়
স্টেফেনি
সত্যি কথা বলতে এটা বলা সঠিক হবে না যে, স্টেফেনি ছাড়া আমার বন্ধুর যুবক বয়সে ভালোবাসার কথাটি সেই সময়ে আরও কেউ জানতো। এই ভালোবাসার গল্পটি তার ষোল বছর বয়স থেকে শুরু হয়েছিল এবং চার বছর পর্যন্ত সেটি তার জীবনের সঙ্গে লেপ্টে ছিলো। আমি ভয় পাচ্ছি এই ভেবে যে, আমার বন্ধুর ভালোবাসার সত্যি ঘটনাটা শুনে অনেকেই হয়তো ভাববেন, কেন আমি তা আপনাদের সামনে প্রকাশ করতে গেলাম। এই মেয়েটির সঙ্গে অ্যাডলফের প্রেমের সম্পর্কটি ছিলো অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার। যদিও বর্তমান যুগে প্রেম-ভালোবাসার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কটিও খুব স্বাভাবিকভাবে চলে আসে। আবার এটা অনেকেই খুব অস্বাভাবিক বলবেন যে, দু’জন  প্রেমিক-প্রেমিকা একত্রে বসে আছে অথচ তাদের মধ্যে ‘কিছুই হয়নি’।
আমি আগেভাগেই আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এ কারণেই যে, আমি মেয়েটির যে ডাক নামটি উল্লেখ করেছি তা ছিলো আদতে তার বিবাহিত নাম। যারা অ্যাডলফকে নিয়ে গবেষণা করেন তাদের সবার জন্যেই আমি এই বিষয়টা আগেভাগেই পরিষ্কার করে নিতে ভালোবাসি। স্টেফেনি সম্ভবত অ্যাডলফের চেয়ে এক বা দুই বছরের বড় হয়ে থাকবে। পরবর্তীতে স্টেফেনি অনেক উচ্চপদস্থ একজন সামরিক কর্মকর্তাকে বিয়ে করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্টেফেনি বিধবা হয়ে ভিয়েনায় অবস্থান করে। পাঠক, আপনারা বুঝতেই পারছেন কেন আমি স্টেফেনি সম্পর্কে আগেভাগেই খোলামেলা আলাপ করতে চেয়েছিলাম।
১৯০৫ সালের বসন্তের কোন এক বিকেলে আমরা দুই বন্ধু মিলে প্রতিদিনের মতোই হাটছিলাম। হঠাৎ করে অ্যাডলফ আমার হাত দু’টো জোর করে ধরলো এবং বললো, আমি এই সুন্দরী সোনালি চুলের মেয়েটি নিয়ে কী ভাবছি। আমি তখন লক্ষ্য করলাম, লেন্ডস্ট্রেসের রাস্তায় একটি মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে হেঁটে বেড়াচ্ছে। অ্যাডলফ বললো, তোমাকে একটা কথা জনাতে চাই, ‘আমি এই মেয়েটার প্রেমে পড়েছি’।
স্টেফেনি ছিলো অসাধারণ সুন্দরী একটি মেয়ে। যেমন সে লম্বা তেমন দেখতেও হালকা-পাতলা গড়নের। তার চুল ছিলো ঘন এবং চুলগুলো সে সবসময় পেছন দিকে ঝুলিয়ে রাখতো। তার চোখ জোড়া ছিলো অসাধারণ-উজ্জ্বল এবং আকর্ষণীয়। তার প্রসাধন ছিলো ব্যতিক্রমধর্মী, যাতে বোঝা যেতো যে, সে অসম্ভব রকম ভালো এবং সম্ভ্রান্ত কোনো পরিববার থেকে এসেছে।
হেনস জিভনির তোলা স্টেফিনির ছবিটি ছিলো ওরফার শহরে। সে যখন স্কুলের গণ্ডি মাত্র পার হয়েছে এবং সম্ভবত অ্যাডলফের সঙ্গে তার পরিচয় ঠিক তার আগের সময়ের। তখন স্টেফেনির বয়স সতের অথবা খুব বড়জোর আঠার হবে। ছবিটাতে দেখা যায়, একটি অসাধারণ হালকা-পাতলা সুন্দরী মেয়ের অবয়ব। তার ছবিটি ছিলো অকৃত্রিম এবং সাধারণ। চুল ছিলো কায়দা করে বাঁধা যা তার মুখের অভিব্যক্তিকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে ফুটিয়ে তুলতো। তার সতেজ মুখশ্রী এবং আকর্ষণীয় চেহারা তাকে সুস্থ-সুঠামদেহী একজন নারীর অবয়ব ফুটিয়ে তুলতো।
সেই বছরগুলোতে সবাই মিলে লেন্ডস্ট্রেসে বৈকালিক ভ্রমণ ছিলো একটি খুব প্রিয় বিষয়। নারীরা দোকানের জানালায় সাজিয়ে রাখা মনোহরি জিনিসপত্রের দিকে ঝুঁকে রয়েছে, কেউ কেউ হালকা কেনাকাটিতে ব্যস্ত, কেউ পুরাতন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় সেখানে নির্মল আড্ডা দিতে নিজেদের ব্যস্ত রাখছেন। সেখানে অনেক সেনাবাহিনীর যুবক অফিসার ঘোরাঘুরি করে পরিবেশটাকে আরও যেনো সুন্দর করে তুলছে। সবকিছু দেখে মনে হয়, স্টেফেনি ওরফার শহরের বাসিন্দা কেননা সে প্রতিদিন মায়ের বাহু আগলে ধরে ওরফার থেকে সাঁকোটা অতিক্রম করে লেন্ডস্ট্রেসে বৈকালিক ভ্রমণ করতে আসতো। প্রায় প্রতিদিন বিকেল ৫টার দিকে মা এবং মেয়েকে লেন্ডস্ট্রেসে আসতে দেখা যেতো। আমরা দু’জনে তাদের দেখতে স্কিয়েডটোরেক এলাকায় অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। এটা অবশ্যই অসৌজন্যমূলক ছিলো যে, সেই মুহূর্তে স্টেফেনিকে দেখে তাকে সম্বোধন করা। যেহেতু আমাদের দু’জনের কেউ তখন পর্যন্ত স্টেফেনির মায়ের সঙ্গে কোনো পরিচয় ঘটেনি। সেই সময় থেকে অ্যাডলফ স্টেফেনিকে না দেখে থাকতে পারতো না। বলা যায়, সেই সময় থেকেই অ্যাডলফ পুরোপুরি বদলে যাওয়া এক মানুষ। অন্তত সে আর নিজের মতো রইলো না। 
আমি জানতে পেরেছিলাম, স্টেফেনির মা ছিলেন বিধবা এবং ওরফাতেই একা একা তিনি বসবাস করেন। তাদের বাড়িতে মাঝে মধ্যেই মধ্যেই একজন যুবকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অ্যাডলফের সবচেয়ে অপছন্দের ছিলো স্টেফেনির ভাইকে নিয়ে যিনি ভিয়েনায় আইন বিষয়ে পড়াশুনা করতেন। এই তথ্যটি অ্যাডলফের জন্যে মোটেও সুখকর ছিলো না। তবে প্রায় সময়ই এই দুই নারীকে একজন যুবক সেনা অফিসারের সঙ্গে দেখা যেতো। খুব স্বাভাবিকভাবেই অপেক্ষাকৃত দরিদ্র, স্বপ্নহীন অ্যাডলফের মতো যুবকের পক্ষে তরুণ সুবিন্যস্ত এবং সুন্দর কাপড় পরা লেফটেনেন্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা সহজ ছিলো না।
অ্যাডলফ বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারতো এবং তার অনুভূতিকে বাস্তাবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতো। সবশেষে তার রাগ পড়তো গোটা অফিসার শ্রেণির সব যুবকদের উপর যাদেরকে সে এক কথায় ‘চতুর গাড়ল’ বলে সম্বোধন করতো। এই বিষয়টি অ্যাডলফকে দারুণভাবে কষ্ট দিতো যে, স্টেফেনি এইসব গাড়লদের সঙ্গে মেশে এবং অন্তর্বাস ও পারফিউম লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

এটা নিশ্চিত যে, স্টেফেনির কোনো ধারণাই ছিলো না অ্যাডলফ তাকে কতো গভীরভাবে ভালোবাসতো। সে অ্যাডলফকে তার সামনে সবসময় লজ্জাবত এবং তার অন্যতম উচ্চ প্রশংসাকারী হিসেবেই বিবেচনা করতো। যখন সে মুচকি হেসে অ্যাডলফের দিকে তাকাতো তখন অ্যাডলফ নিজেকে এতোই সুখী মনে করতো যে তার মনের ভাবটা পরিবর্তন হয়ে যেতো এবং তাকে এমন সুখী হতে আমি খুব কমই দেখেছি। সেই সময় তার চোখে পৃথিবীর সব কিছু অসাধারণ সুন্দর আর সঠিক বলে ধরা পড়তো। কিন্তু যদি কখনও স্টেফেনি কোনোভাবে অ্যাডলফকে এড়িয়ে যেতো বা তাকে পাত্তা দিতো না তখন সে অন্যরকম হয়ে যেতো। নিজেকে এবং গোটা পৃথিবীটাকে ধ্বংস করার মতলব আঁটতো।
স্বাভাবিকভাবেই যারা প্রথম প্রেমে পড়তো তাদের জন্যে এই বিষয়টি খুব স্বাভাবিক ছিলো। কেউ হয়তো স্টেফেনির প্রতি অ্যাডলফের যে ভালোবাসা ছিলো তা বাচ্চাদের ভালোবাসা বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। এটা এক দিক থেকে সত্যও হতে পারে যেহেতু স্টেফেনির দিকে অ্যাডলফের প্রতি তার কেমন ভালোবাসার টান রয়েছে সেটি ভাবাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অ্যাডলফের দিক থেকে স্টেফেনির প্রতি তার ভালোবাসায় কোনো ‘ছেলেমানুষি’ ছিলো না। এটা সত্য যে, তাদের ভালোবাসার সম্পর্কটি দীর্ঘ চার বছর পর্যন্ত গড়িয়েছিল এমনকী, এর পরবর্তী সময়গুলোতেও অ্যাডলফ যখন ভিয়েনায় খুব দৈন্য দশার মধ্যে যাচ্ছিলো তখনও তার স্টেফেনির প্রতি ভালোবাসা খাঁটি, গভীর এবং সত্যিকারের ভালোবাসা বিদ্যমান ছিলো। এর সত্যতা হিসেবে সেই সময়ে অ্যাডলফের হৃদয় মন্দিরে স্টেফেনি ছাড়া আর কোনো রমণীর উপস্থিতি ছিলো না। একজন সাধারণ বালক যেভাবে তার প্রথম ভালোবাসাকে বুকে নিয়ে পথ চলে অ্যাডলফ তার থেকে ব্যতিক্রম কেউ ছিলো না।

পর্ব-১৬

ষষ্ঠ অধ্যায়
অ্যাডলফ সর্বক্ষণ তার মায়ের কাছে এটাই প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো যে, গতানুগতিক পড়াশুনা জীবনে কোনো কাজে লাগে না। ‘তারচেয়ে বরং একজন ব্যক্তি নিজের চেষ্টায় অনেক বেশি জ্ঞানী হতে পারে’। সে বিসমার্কস্ট্রেসে অবস্থিত গণশিক্ষা পাঠাগারের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করলো এবং সেখান থেকে বিনামূল্যে কীভাবে বই ধার করে পড়া যায় সে কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। সে তখন প্রায়সময়ই স্টুয়েলার অ্যান্ড এল হেসলিং বুক কোম্পানি থেকে ধার করে বই পড়তে শুরু করলো। আমার মনে পড়ে, সেই সময় থেকে সে দিনরাত  বইকে আগলে ধরে সময় কাটাতো। সেই সময় পঠিত তার প্রিয় বইটির নাম ছিলো ‘জার্মান বীরদের গল্পকথা’। এ বইটি তার গোটা জীবনের সঙ্গে সারাক্ষণ লেপ্টে ছিলো। বই নিয়ে সে আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে চাইতো। আমি আমার ব্যস্ত জীবনের কাজকর্ম শেষ করে যখন তার বাড়ি যেতাম তখন তার অনুপ্রেরণায় আমাকে বিভিন্ন স্বাদের বই পড়তে হতো শুধুমাত্র তার সঙ্গে বই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চালিয়ে নেওয়ার জন্যে। সে তখন আমার সদ্য পড়া কোনো বই নিয়ে আমার সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে মেতে উঠতো। হঠাৎ করেই গতানুগতিক স্কুলের পড়াশুনায় সে যেমন বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলো পাশাপাশি ঠিক একইভাবে সে ব্যক্তিগত পড়াশোনাতেও বেশি পরিমাণ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলো। একান্ত প্রচেষ্টায় সে পড়াশুনা করে নিজেকে শানিত করে তুললো এবং স্কুলের অভাব পুরণ করলো।
১৯২৩ সালে লিজ রিয়েল স্কুলে অ্যাডলফ হিটলার খুব ব্যর্থতার সঙ্গে হাইস্কুল পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলো। সেই সময় তার শিক্ষক ছিলেন প্রফেসর হুয়েমার। তিনি অ্যাডলফ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,
‘এক দিক থেকে ভাবলে হিটলার ছিলো গড গিফটেড একটি মেধাবী বালক (ছাত্র হিসেবে)। ব্যক্তি জীবনের শৃঙ্খলাবোধ নিয়ে সে খুব একটা সচেতন ছিলো না এবং প্রাতিষ্ঠানিকতার  বিরুদ্ধে সে সবসময় অবস্থান নিতে ভালোবাসতো। যে কারণে গতানুগতিক পড়াশুনায় নিজেকে মানিয়ে নিতে তার কষ্ট হতো। যদি সে এসব বিষয় কাটিযে উঠতে পারতো তাহলে সে অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ ফল করতে পারতো’।
অধ্যাপক হুয়েমার তার বিরূপ মন্তব্যের শেষদিকে এসে আবেগঘনিষ্ট হয়ে আরও যোগ করলেন,
‘জীবনের অভিজ্ঞতা আমাদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে। আমাদের ছাত্ররা কেউই সে শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে না। যে কারণে দেখা যায় অনেক উদীয়মানরাও সাফল্যের চূড়ায় যাওয়ার আগেই অকালে ঝরে যায়। এটা বুঝতে হবে যে, স্কুলের পাস প্রকৃত অর্থে কিছুই না যতোক্ষণ না ছাত্রটি তার শিক্ষাকে জীবনমুখী করতে পেরেছে। এটা স্পষ্ট যে, আমার প্রাক্তন ছাত্র হিটলার শেষের এই ক্যাটাগরিতেই পড়ে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করবো, সে যেনো তার ইস্পিত ঠিকানাটি পেয়ে যায় এবং জীবনের সবরকম যন্ত্রনা থেকে মুক্তি লাভ করে’।
অধ্যাপক মশাইয়ের এই কথাগুলো ১৯২৪ সালে যখন লিপিবদ্ধ করেছিলেন তখন তা ছিলো সম্পূর্ণরূপে ‘রাজনৈতিক’ উদ্দেশ্য বর্জিত। এই বাক্যগুলোর মাধ্যমে একজন শিক্ষক এবং তার ছাত্রের মধ্যে অসাধারণ ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। অধ্যাপক হুয়েমার তার লেখায় অ্যাডলফ হিটলার সম্পর্কে যে ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন তা পরবর্তীতে সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো। হিটলার ক্লাসে ভালো কোনো ছাত্র ছিলো না। এমনকি অধ্যাপক হুয়েমারের নেওয়া জার্মান ভাষা শিক্ষা ক্লাসেও সে ভালো ফল করতে পারেনি। পরবর্তীতে আমাকে লেখা তার জার্মান ভাষায় পত্রাবলি এবং বিভিন্ন উৎসবে পাঠানো পোস্টকার্ডে তার ভুলভাল জার্মান লেখাতেও তার প্রমাণ পেয়েছিলাম।
হিটলারের আরেকজন শিক্ষক ইতিহাসের নাম থিয়োডর গিসিংগার যিনি হিটলারের রাজনৈতিক দুরদর্শতির অনেক গুণকীর্তন করেছিলেন। গিসিংগার অধ্যাপক এংসলারের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। গিংসিংগার স্কুলের বাইরে বিভিন্ন রকম আউটডোর কাজকর্ম করতে ভালোবাসতেন। তিনি পর্বত আরোহণ থেকে শুরু করে দূরপাল্লায় ভ্রমণবিলাস সব কাজই করতেন। তিনি ছিলেন সব জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কঠোর। সেসময় রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণ এবং স্কুলের নিয়মনীতি অনেক কঠোরভাবে মেনে চলা হতো। আর এই বিষয়টি হিটলারের মানসিক বিকাশের পথে ছিলো চরম অন্তরায়। অধ্যাপক গিসিংগার তার প্রাক্তন ছাত্রটি সর্ম্পকে স্মৃতিকথায় লিখলেন,
‘লিজে থাকাকালীন হিটলার ভালো কী খারাপ, কোনো ছাপই আমার কাছে রাখতে পারেনি। সে ক্লাসের নেতৃস্থানীয় কেউ ছিলো না। দেখতে সে ছিলো শীর্ণকায়, মুখটি ছিলো বুদ্ধিদীপ্ত, শান্ত। সে ছিলো কৌতুহলী এবং তার চোখ ছিলো জ্বলজ্বলে’।

তৃতীয় আরেকজন ইতিহাসের অধ্যাপক ডক্টর লিয়োপোল্ড পোচ হিটলারের গুণকীর্তন করে একটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন। তিনি একমাত্র অধ্যাপক যিনি তার ছাত্র হিটলারের বহুমুখী প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। এ বিষয়টি অ্যাডলফ হিটলারের আত্মজীবনী ‘মেইন ক্যাম্ফ’-এ বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
‘আমার ইতিহাসের শিক্ষক আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছিলেন তা সম্ভবত আমার পরবর্তীতে জীবনে আমার পাথেয় হয়ে থাকবে। যারা তাকে চেনেন তারা জানেন যে, তিনি তার ক্লাস এবং পরীক্ষা নিয়ে কতো বেশি মগ্ন থাকতেন। জীবনে যা অপ্রয়োজনীয় তিনি তা পরিহার করে চলতেন। আমার ইতিহাসের শিক্ষক ডক্টর লিয়োপোল্ড পোচ এই আদর্শ শিক্ষকের আচরণে তার প্রতি মাথা সবসময় শুধুই নত হয়ে আসে তা নয় পাশাপাশি তার কথা ভাবলেই যেনো অনুপ্রেরণা খুঁজে পাই’।

লিয়োপোল্ড পোচই একমাত্র শিক্ষক যাকে নিয়ে হিটলার তার মেইন ক্যাম্ফে আড়াই পাতা বিষদভাবে লিখেছিলো। হতে পারে শিক্ষকের প্রতি তার এই ভালোবাসার প্রকাশ অনেকটাই অতিরিক্ত ছিলো কিন্তু এই বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে যে, হিটলার শুধুমাত্র তার এই শিক্ষকের ইতিহাস ক্লাস থেকেই ‘সন্তোষজনক’ ফল পেয়েছিলো। সম্ভবত তার স্কুল পরিবর্তনও এমন ফল হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে তবে এটাও ঠিক যে, ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক যেভাবে এক যুবক ছাত্রের মনোজগত তৈরি করে দিয়েছিলেন, তার সেই দক্ষতাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।
পোচ দক্ষিণ অস্ট্রিয়ান ছিলেন। সেখান থেকে তিনি লিজে পড়ানোর আগে তিনি মারবার্গ এন ডার ড্রাও (পরবর্তী যুগোস্লাভিয়াতে অবস্থিত) এবং বিভিন্ন স্কুলেও পড়িয়েছিলেন। যে কারণে তিনি তার সঙ্গে করে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। আমার মনে হয় জার্মান ভাষাভাষী মানুষের প্রতি অদম্য ভালোবাসাই হয়তো যুবক হিটলারের প্রতি তার দুর্বলার কারণ হয়ে দাড়িয়েছিলো। হিটলার সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই তার স্কুল জীবনের ইতিহাসের শিক্ষককে তার স্মৃতিকথায় স্মরণ করেছিলো। ১৯৩৮ সালে হিটলার যখন ক্লেগেনফার্ট পরিদর্শন করে তখন অধ্যাপক পোচের সঙ্গে তার আবার দেখা হয়েছিলো। তিনি তখন লেভেন্থালের সেন্ট অনড্রিল স্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন। হিটলার এক ঘণ্টা একান্তে তার প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলো। তাদের আলাপচারিতায় কোনো সাক্ষী ছিলো না তবে জানা যায়, হিটলার যখন তার শিক্ষকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে তখন সে তার দেহরক্ষীকে বলেছিলো, ‘তোমার কোনো ধারণাই নেই যে, আমি কী পরিমাণে এই বৃদ্ধ লোকটার কাছে ঋণী হয়ে আছি’। 
একজন শিক্ষকের প্রতি কী পরিমাণ ভালোবাসা থাকলে অ্যাডলফ হিটলার তার প্রাক্তন শিক্ষক সম্পর্কে এ ধরনের প্রশংসামূলক কথা বলতে পারে যা ছিলো তার প্রতি সহপাঠীর বিরূপ মন্তব্যের ঠিক বিপরীত*। আমি নিজে সাক্ষী, অ্যাডলফ তার স্কুল ছেড়েছিলো শুধুমাত্র স্কুলের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা থেকেই। স্কুল নিয়ে যখনই আমরা কোনো আলোচনায় মেতে উঠতাম তখনই সে রেগেমেগে আগুন হয়ে যেতো। স্কুল ছাড়ার পর সে কোনো শিক্ষক বা ছাত্র এমনকি অধ্যাপক পোচের সঙ্গেও কোনোরকম যোগাযোগ রাখেনি। রাস্তায় কখনও হঠাৎ করে তাদের মুখোমুখি হয়ে গেলে সে তাদেরকে কৌশলে এড়িয়ে যেতো।
*স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে হিটলারের সম্পর্ক কখনই ভালো ছিলো না। হিটলার তাদের ঘৃণা করতো একারণেই যে, তার ধারণা ছিলো এরা সবাই বড় হয়ে অমানুষ হবে। সরকারি বড় কোনো কর্মকর্তা হবে। আর কিছুই নয়।